
দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল। স্বনামধন্য এ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (Rangpur Metal Industries Limited) এবং রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ এলটিডি. (Rangpur Metal Industries Ltd.)। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারি এবং লিফট সরবরাহের কাজ করে এই দুই প্রতিষ্ঠান। নামের মিলের কারণে প্রতিষ্ঠান দুটিকে একটি ভেবে ভুল হতে পারে। আবার Limited শব্দটিকে অনেক ক্ষেত্রে সংক্ষেপে লেখা হয় Ltd.। শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ লেখার এই প্রচলিত পদ্ধতিকেই কারচুপির পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাণ-আরএফএল। ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে সুকৌশলে এ কাজটি করেছে তারা। একটি কোম্পানির অনুমোদন নিয়ে Limited এবং Ltd. নাম দিয়ে আলাদা দুটি আইডি করে সরকারি ঠিকাদারিতে অংশ নিচ্ছে প্রাণ-আরএফএল। যদিও প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট জমা দেয় একটি আইডির কাজের অনুপাতে। দীর্ঘদিন ধরে অভিনব এ জালিয়াতি করে এলেও সম্প্রতি ধরা পড়েছে বিষয়টি।
নথিপত্র অনুযায়ী, Rangpur Metal Industries Limited এবং Rangpur Metal Industries Ltd.—এই প্রতিষ্ঠান দুটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে গত ১০ বছরে প্রায় ২০৫টি কাজ করেছে। টাকার অঙ্কে যা হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে, Ltd. নামে কাজ পেলেও দরপত্রে ভ্যাট সনদ দেওয়া হয়েছে Limited-এর। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৭৭০ কোটি টাকার কাজ করেছে Ltd. আর Limited করেছে ২৮০ কোটি টাকার। অর্থাৎ ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য কম কাজ করা প্রতিষ্ঠানের নামে সনদ নেওয়া হয়েছে। পরে কৌশলে এক প্রতিষ্ঠানের দরপত্রে অন্য প্রতিষ্ঠানের সনদ সংযুক্ত করা হয়।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের কয়েকজন প্রকৌশলী কালবেলাকে জানান, একই প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে দরপত্র দাখিল করে ২০৫টি কাজ প্রাপ্তির মাধ্যমে ই-জিপি নির্দেশিকা, পিপিআর ২০০৮, আইটিটি, জিসিসি এবং সরকারি টেন্ডার নীতিমালার লঙ্ঘন। রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ এলটিডি. নামের সামান্য পার্থক্য থাকলেও, উভয় প্রতিষ্ঠান একই বিন। পরিচালক, অফিস ঠিকানা ও উৎপাদন কাঠামো ব্যবহার করে সরকারি ই-জিপি (e-GP) প্ল্যাটফর্মে আলাদা আলাদা রেজিস্ট্রেশন করে আসছে। এর ফলে তারা একই দরপত্রে নামে-বেনামে অংশগ্রহণ করা মানে অসৎ উপায়। একই বিন দিয়ে দুটি অ্যাকাউন্ট খোলা বা মিথ্যা নিবন্ধন করলে তা বাতিলযোগ্য ও শাস্তিযোগ্য। কারণ, সরকারের ভ্যাট ও ট্যাক্স ফাঁকির উদ্দেশ্যে এসব করা হয়ে থাকে। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট ধারা ২০০৮ অনুসারে একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে একাধিক দরপত্র দাখিল সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এ ধরনের অনিয়ম ও প্রতারণা প্রমাণিত হলে দরপত্র বাতিল করার পাশাপাশি কোম্পানিটি কালো তালিকাভুক্তি, ক্ষতিপূরণ দাবির আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৬ সাল থেকে ই-জিপি সিস্টেমে একই কোম্পানি দুটি আইডি ব্যবহার করে দরপত্র দাখিল করছে এবং ওয়ার্ক অর্ডার পাচ্ছে। এর মধ্যে রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড মোট ২৮০ কোটি এবং রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ এলটিডি. ই-জির তথ্যানুসারে ৭৭০ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে। কিন্তু কোম্পানির ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) অডিটিং ফার্মের তথ্যমতে, শুধু রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, যা সরকারের ভ্যাট বা ট্যাক্স বৃদ্ধি বা কম দেখানোর চেষ্টা করার জন্যই এই কৌশল প্রয়োগ করছে কোম্পানিটি।
২০১৬ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ২০৫টি কাজের তথ্য এসেছে কালবেলার হাতে। সরকারের নথি বলছে, এর মধ্যে এ বছরের জুন পর্যন্ত ৪১টি কাজ, গত বছর ৩২টি, ২০২৩ সালে ২৮টি, ২২ সালে ৩৯টি, ২১ সালে ১৯টি, ২০ সালে ১৭টি, ১৯ সালে ১৪টি, ১৮ সালে ১২টি, ১৭ সালে দুটি ও ২০১৬ সালে একটি কাজ করে কোম্পানিটি। ২০৫টি কাজের মধ্যে রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড গত বছরে ৯৩টি কাজ করেছে। অন্যদিকে, রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ এলটিডি. করেছে ১১২টি কাজ। মূলত কোম্পানিটি কাজ চালু করে রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নাম দিয়ে। এর এক বছর পর রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ এলটিডি. কাজ শুরু করে এবং ২০১৮ সালে প্রথম একসঙ্গে রংপুর জোনের তিনটি কাজ নেয় আওযামী লীগের এক নেতার সুপারিশে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, ঢাকা ওয়াশা, পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন অধিদপ্তরে কাজ করেছে কোম্পানিটি। এ ছাড়া গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্পে লিফটের কাজ করেছে। এখনো বেশ কিছু অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে কাজের চুক্তি রয়েছে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (ই/এম বিভাগ-৪) নিয়াজ মো. তানভীর আলম সম্প্রতি বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটিকে (বিপিপিএ) চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে রিভিউ প্যানেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০২৬ সাল থেকে রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ এলটিডি. দুটি আইডি ব্যবহার করে দরপত্র দাখিলে এবং ওয়ার্ক অর্ডার ইস্যু করছে। ই-জি সিস্টেমে একটি ট্যাক্স ও ভ্যাট দিয়ে শুধু একটি কোম্পানিই রেজিস্ট্রেশন করতে পারে। কিন্তু উল্লিখিত দুই কোম্পানির অ্যাকাউন্ট যেহেতু দুটি। তাই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হয় যে, এখানে জাল-খালিয়াতি করা হয়েছে। চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ই-জির তথ্য অনুযায়ী, রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড মোট ২৮০ কোটি এবং রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ এলটিডি. ৭৭০ কোটি (ই-জিপি তথ্যানুসারে) টাকার কাজ পেয়েছে। কিন্তু কোম্পানির ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেমে শুধু রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের তথ্য আছে। এ ক্ষেত্রে ভ্যাট বা ট্যাক্স বৃদ্ধি বা কম দেখানোর চেষ্টা করা হয়ে কি না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন নির্বাহী প্রকৌশলী তানভীর। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দরপত্রে টেন্ডার আইডি ১০৬০৬৯৯-এর ভ্যাট সনদটি দাখিল করেছে রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ এলটিডি.। কিন্তু দাখিল করা সনদটি মূলত রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের। কোম্পানির পিপিআর ২০০৮-এর ১২৭ অনুসারে এ ক্ষেত্রে প্রতারণার সুযোগ নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন তানভীর আলম। চিঠিতে বিষয়টি খতিয়ে দেখার অনুরোধও জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকৌশলী তানভীর আলম বলেন, রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ এলটিডি. পৃথক নামে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে। তাদের বিষয়ে বিপিপিএ থেকে যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছে, আমি তা পাঠিয়েছি।
এ বিষয়ে কয়েকজন প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি যথাযথ মনিটরিং করতে পারেনি। এভাবে বছরের পর বছর গোপন কারসাজি চললেও বিষয়টি আঁচ করতে না পারার কোনো কারণ নেই।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল কালবেলাকে বলেন, রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ এলটিডি. নামে আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। কাজও আলাদা করে নেওয়া হয়নি। আমাদের একটি কোম্পানি, একটি কোম্পানিরই ভ্যাট-ট্যাক্স দেওয়া হয়। দুই কোম্পানির নামে আলাদা করে ঠিকানা দেওয়ার বিষয়টিও মিথ্যা।
রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ এলটিডির প্রধান প্রকৌশলী সমীর কুমার সাহা কালবেলাকে বলেন, একই নাম দিয়ে দুই কোম্পানির কাজ করার কথা নয়। ভ্যাট সনদ ও টিন সার্টিফিকেট এসব বিষয়ে কোম্পানির লোকজন জানে। তবে এসব বিষয় নিয়ে গণপূর্তের পাঠানো চিঠির জবাব দিয়েছে কোম্পানি।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন কালবেলাকে বলেন, আমাদের দেশে সাধারণত limited ও ltd. একইভাবে ব্যবহার হয়। যদি কোনো কোম্পানি limited ও ltd. দুটি কোম্পানি করে, তাহলে এটা ‘রেজিস্টার আর জয়েন্টস্টক অব কোম্পানি অ্যান্ড ফার্ম’ (আরজিসি) আইনে অপরাধ। আরজিসির এভাবে কোনো নাম অনুমোদন দেওয়ার কথা নয়। তার পরও যদি করে, তাহলে ধরে নিতে হবে আরজিসি ম্যানেজ করেই করছে। একই নাম দিয়ে দুটি কোম্পানি চালানো সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে কোম্পানির অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এ ধরনের কাজ কোনো কোম্পানি করে থাকলে তা জালিয়াতি। কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল থেকে শুরু করে জেল-জরিমানাসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।