Image description
♦ রূপনগরে বিষাক্ত ধোঁয়া, ২৮ ঘণ্টায় নিয়ন্ত্রণে আগুন ♦ তদন্ত কমিটি গঠন ♦ নিহতদের ২ লাখ ও আহতদের ৫০ হাজার

আবদুল আলীম (১৪) প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবার সকালেও গিয়েছিলেন পোশাক কারখানায় কাজে। বেলা ১১টার পর থেকে আলীম পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। আগুনের খবর পেয়ে রূপনগর আবাসিক এলাকার ২৩ নম্বর রোডের বাসা থেকে ছুটে আসেন তার বড় বোন নূরজাহান বেগম। দিনভর অনেক চেষ্টা করেও ভাইয়ের সন্ধান পাননি তিনি। দিনশেষে রাতেও রাজধানীর রূপনগরের শিয়ালবাড়ির ওই পোশাক কারখানার সামনে আহাজারি করছিলেন নূরজাহান বেগম। উপায় না পেয়ে ছুটে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে।

গতকালও ছোট ভাইয়ের খোঁজ পাননি তিনি। একই সময়ে একই কারখানায় কাজে গিয়েছিলেন আল-মামুন নামে আরেক যুবক। কিছুক্ষণ পরই ঘটে অগ্নিকাণ্ড। অনেক খোঁজাখুঁজির পর মর্গে মামুনের হাতের আংটি দেখে লাশ শনাক্ত করেন বোন মাহমুদা খাতুন। তাদের গ্রামের বাড়ি বরগুনার আমতলীতে। ঢামেক জরুরি বিভাগের মর্গে শিয়ালবাড়ি অগ্নিকাণ্ডে নিহত ১৬ জনের লাশ রাখা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতেই লাশগুলো এখানে আনা হয়। রাত থেকেই নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনরা এখানে আসেন। এর মধ্যে ৯ জনের লাশ শনাক্ত করা গেছে। শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েন আপনজনের খোঁজে আসা মানুষগুলো। প্রায় ২৮ ঘণ্টা পর গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টায় শিয়ালবাড়ির পোশাক কারখানা রাইজিং ফ্যাশন ও কেমিক্যাল গুদাম কসমিক ফার্মাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনার ঘোষণা দেয় ফায়ার সার্ভিস। তবে নতুন করে কোনো লাশ না পাওয়ারও তথ্য জানায় সংস্থাটি। নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেক পরিবারকে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে ২ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা এবং আহত শ্রমিকদের চিকিৎসায় ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে শ্রম মন্ত্রণালয়। কেমিক্যালের তেজষ্ক্রিয়তায় এলাকাটিকে সম্পূর্ণ বিপজ্জনক জানিয়ে মাইকিং করে সতর্ক থাকার অনুরোধ করেছে ফায়ার সার্ভিস।

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং অগ্নিকাণ্ডে আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি তিনি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান এ প্রতিবেদককে জানান, ৭টি লাশের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের পরিচয় শনাক্ত করে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে।

ময়নাতদন্তের জন্য লাশগুলোর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন রূপনগর থানার এসআই মোখলেছুর রহমান। তিনি বলেন, ময়নাতদন্তের পর লাশ মর্গে রাখা হবে। দাবিদার বা নিখোঁজ পরিবারে পক্ষ থেকে ডিএনএ নমুনা নিয়ে স্বজনদের সঙ্গে মিল পাওয়ার পর লাশ হস্তান্তর করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে।

গতকাল সকালে একটি ছবি হাতে নিয়ে ঢামেক মর্গের সামনে অপেক্ষা করছিলেন শরাফাত হোসেন। ছবিটি ছিল তার ভাতিজা তোফায়েল আহমদের (২১)। জানালেন, তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। তোফায়েল আহমদ এসএসসি পাস করে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কয়েক মাস আগে তিনি রূপনগরের একটি মেসে থাকতেন। অপেক্ষার সময়টুকু পোশাক কারখানায় যোগ দিয়েছিলেন। তবে আগুনে পুড়ে শেষ হলো তার বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন। মঙ্গলবার রাতেই শরীরের পোশাক দেখে তোফায়েলের লাশ শনাক্ত করা হয়।

নার্গিস আক্তার (১৯) মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ওই পোশাক কারখানায় কাজে যোগ দিয়েছিলেন। তার পায়ের নূপুর ও মাথার খোঁপা দেখে শনাক্ত করেন ছোট বোন মৌসুমি আক্তার। মর্গের সামনে আহাজারি করতে করতে মৌসুমি জানান, গত বছর নার্গিস আক্তার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্কুল ও কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তাদের বাবা ওয়াজিউল্লাহ ফলের আড়তে কাজ করেন। তারা চার বোন। নার্গিস ছিলেন দ্বিতীয়। বাবার একার আয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। সে কারণে নার্গিস পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেছিলেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ওই কারখানার লাইনম্যানের ফোন পেয়ে তারা ঘটনাস্থলে যান। রাতেই বাবার সঙ্গে ঢামেকে পায়ের নূপুর দেখে বড় বোনের লাশ শনাক্ত করেন। সরেজমিন আরও জানা যায়, রূপনগর আবাসিক এলাকার ৯ নম্বর সড়কে মাহিরা আক্তার (১৪) ও সানজিদা আক্তারকে (১৫) নিয়ে থাকেন মা ফাতেমা বেগম। তাদের গ্রামের বাড়ি বরগুনা সদরে। স্বামী ফারুক হোসেন প্রয়াত। তিনি নিজেও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। কাজের সামর্থ্য নেই। দুই মেয়ে পোশাক কারখানায় কাজ করে। তাদের আয়েই চলে সংসার। ছোট মেয়ে মাহিরা কাজ করত শিয়ালবাড়ির কারখানাটির তৃতীয় তলায়। মেয়েকে হারিয়ে মর্গের সামনেই বিলাপ করছিলেন ফাতেমা। পাশে বসা আরেক মেয়ে সানজিদা আক্তার জানালেন, তিনি অন্য একটি কারখানায় কাজ করেন। অগ্নিকাণ্ডের খবরে রাতেই তারা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। পরে মর্গে এসে পোশাক দেখে বোনের লাশ শনাক্ত করেন।

অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে নিখোঁজ থাকা মৌসুমি আক্তার (২০), মারজিয়া সুলতানা (১৯), মুক্তা বেগম (২০) এবং খালিদ হোসেনের (২৯) ছবি নিয়ে মর্গে অপেক্ষা করছিলেন স্বজনরা। ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের জানান, আগুনে লাশগুলো খুবই খারাপভাবে পুড়ে গেছে। এর মধ্যে ৯ জন পুরুষ ও ৭ জন নারী। তবে পোশাক-আশাক ও নানা আলামত দেখে ১০ জনের লাশ শনাক্তের দাবি করেছেন স্বজনরা। এ বিষয়ে পুলিশ যাচাই করে রিপোর্ট দেবে। পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের অনুমোদন পেলেই আত্মীয়দের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে।

গতকাল সকাল থেকেই শিয়ালবাড়িতে রাইজিং ফ্যাশনের সামনে ভিড় করেন অসংখ্য শ্রমিক। কেউ এসেছেন নিজেদের কর্মস্থলের অবস্থা দেখতে, কেউ বা জানতে চান কারখানা খোলা হবে কি না।

উপস্থিত শ্রমিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ওই ভবনের ছাদে ওঠার দরজা দুটি তালা দিয়ে বন্ধ থাকায় অনেকেই বের হতে পারেননি। এ কারণে আগুনে পুড়ে মারা যান ১৬ জন।

বিকালে আগুনের ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, গার্মেন্টসের আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। পাশে থাকা কেমিক্যাল গোডাউনের আগুনও নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে গোডাউনে ৬-৭ ধরনের কেমিক্যাল থাকায় সতর্কতা অব্যাহত রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেখানে উদ্ধার অভিযান শুরু করতে ২৪-৭২ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। অগ্নিকাণ্ডে ভবনটি অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং কলামসহ বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে ভবনে সরাসরি সার্চ অপারেশন চালানো ঝুঁকিপূর্ণ। আগুন লাগা আলম ট্রেডার্সের মূল ফটক তালাবদ্ধ ছিল। ফায়ার সার্ভিসের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে কেটে খুলতে হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে মানুষ ছিল না। তবে সার্চ অপারেশন না চালানো পর্যন্ত বলতে পারব না মানুষ ছিল কি না। অবৈধ রাসায়নিক গুদামের তালিকায় আলম ট্রেডার্সের নাম আগে থেকেই ছিল। প্রতিষ্ঠানটিকে তিনবার নোটিস দেওয়ার পরও তারা কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান জানান, ফায়ার সার্ভিসের বিশেষজ্ঞ দল সকালে কেমিক্যাল স্যুট পরে গুদামের প্রধান ফটক খুলতে সক্ষম হয়েছে।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি গঠন : শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অগ্নিকাণ্ডের কারণ, দায়দায়িত্ব নির্ধারণ এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে সুপারিশ দেওয়ার জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব লস্কর তাজুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন দাখিল করবে। এ ছাড়া দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ, আহত ও নিহতদের তালিকা প্রণয়ন, পরিদর্শন প্রক্রিয়ায় কোনো গাফিলতি আছে কি না তা খতিয়ে দেখা, কারখানার ঝুঁকি নিরূপণ, ঝুঁকি নিরসনের সুপারিশ এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ বিষয়ে সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে দাখিল করবে তদন্ত কমিটি।

জনবহুল এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউন না থাকার বিষয়ে স্ট্রং পলিসি থাকতে হবে : সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেছেন, জনবহুল এলাকায় যেন কেমিক্যাল গোডাউন না হয়, সে বিষয়ে স্ট্রং পলিসি থাকতে হবে।

গতকাল মিরপুর রূপনগরে দুর্ঘটনাকবলিত গোডাউনের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। উপদেষ্টা বলেন, আমি ঘটনাস্থল দেখতে এসেছি। এ ধরনের কেমিক্যাল যেখানে রাখা হয়, এগুলো হচ্ছে বেআইনি জায়গা। আমি মনে করি, প্রথম যে জিনিসটি করতে হবে, সরকারকে ইমিডিয়েট ইনভেস্টিগেশন করতে হবে। যারা এটা করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে এবং আমাদের স্ট্রং পলিসি থাকতে হবে। যেন জনবহুল এলাকায় এ ধরনের ক্ষেত্রগুলো না থাকে।

এ উপদেষ্টা আরও বলেন, পুরান ঢাকায় এর আগেও এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। পরে জনবহুল এলাকা থেকে সেসব গুদাম সরিয়ে দেওয়া হলেও অনেক মালিক রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে নতুনভাবে এসব স্থাপন করেছেন। এ স্থানগুলো চিহ্নিত করে জরুরি ভিত্তিতে উচ্ছেদ করতে হবে। প্রয়োজনে নীতিমালা পরিবর্তন করে হলেও এমন বিপজ্জনক কর্মকাণ্ড জনবহুল এলাকা থেকে সরাতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। শারমীন এস মুরশিদ বলেন, যে মানুষগুলো মারা গেছেন, আমরা যতটুকু পরিসংখ্যান পেয়েছি, হাসপাতালে আমার মন্ত্রণালয় থেকে হেল্প ডেস্ক রয়েছে। আমাদের সমাজকর্মীরা সেখানে রয়েছেন। তারা এটা ফলোআপ করবেন এবং তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবেন। যা যা সাহায্য সহযোগিতা করা সম্ভব আমরা সেটি করব। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিবারগুলোর পাশে থাকবে, সে নিশ্চয়তা আমি দিচ্ছি।