
মাহিরা। মাত্র ১২ বছরে পা রেখেছে। শিশুকালেই মারা যান তার বাবা ফারুক হোসেন। এরপর থেকেই শুরু হয় মাহিরার জীবন সংগ্রাম। অভাব-অনটনের সংসারে দুই সন্তানকে নিয়ে কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসেন তার মা ফাতেমা বেগম। মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় মিরপুরে মামা শফিকুলের ভাড়া বাসায়। নতুন জীবনের খোঁজে মাহিরার বড় বোন সানজিদা চাকরি নেয় গার্মেন্টসে। সংসারের অভাব ঘুচাতে মিরপুরের শিয়ালবাড়ির পোশাক কারখানায় চাকরি নেয় মাহিরাও। কিন্তু চাকরিতে যোগ দেয়ার ১৪ দিন পরই আগুনে দগ্ধ হয়ে নিভে গেল তার জীবন প্রদীপ।
গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে বসে কাঁদছিলো মাহিরার বড় বোন সানজিদা। কিছুক্ষণ পরপর লুটিয়ে পড়ছিলো মাটিতে। এ সময় কাঁদতে কাঁদতে সে বলে, বাতের ব্যথায় ক’দিন আগেই মা মাহিরার পায়ে ব্যান্ডেজ পরিয়ে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন এতে ব্যথা কিছুটা কমবে। কিন্তু সেই ব্যান্ডেজই হলো শেষ পরিচয়ের চিহ্ন। ঢামেকের মর্গে সেই কালো ব্যান্ডেজ পরা দেহের দিকে তাকিয়ে দেখি এই আমার মাহিরা। আমার বয়স ১৫ বছর। মাহিরার ১২। আমরা খুব ছোট বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। মা অভাব-অনটনের সংসারে আমাদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। এখানে এসে মামার ভাড়া বাসায় থাকি। সে বলে, কিছুদিন পরে আমি একটি গার্মেন্টসে চাকরি নিই। তাতেও খুব ভালো চলতে না পারায় মাহিরাও চাকরি নেয়। ১লা অক্টোবর মিরপুরের শিয়ালবাড়ির পোশাক কারখানায় চাকরিতে যোগ দেয় মাহিরা। ১৪ দিনের মাথায়ই আগুনে কেড়ে নিলো আমার বোনের জীবন। সানজিদা বলে, পরশু রাতে আমার নাইট ডিউটি ছিল। মাহিরা মজা করে বলেছিল, ‘তুমি নাইট ডিউটিতে, আমি কিন্তু সকালে আগে ঘুম থেকে উঠবো।’ তার সঙ্গে একটু ঝগড়া হয়েছিল। কে জানতো সেটাই আমাদের শেষ কথা হবে। মায়ের অবস্থা অনেক খারাপ। তিনি মেয়ের মরদেহ দেখার পর থেকে কিছুই খাননি। মাহিরার মরদেহ পেলে মিরপুর কবরস্থানে দাফন করা হবে।
শুধু মাহিরা নয়, মাহিরার মতো আরও অনেকে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। তাদের বেশির ভাগেরই বয়স কম। অধিকাংশই অভাব-অনটনের সংসারে হাল ধরতে ও বাবা-মা’কে সহযোগিতা করতে ঢাকায় এসে যোগ দিয়েছিলেন চাকরিতে। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। আগুনে কেড়ে নিয়েছে পরিবারের সুখ আর স্বপ্ন। প্রিয়জনদের হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছে পরিবারগুলো। ঢামেকের মর্গের সামনে ছিল আহাজারিতে ভরপুর। কেউ তাদের প্রিয়জনের ছবি বুকে চেপে কাঁদছেন, আবার কেউ মরদেহগুলো একনজর দেখার জন্য মর্গে ছুটছেন। পরিবারের স্বজনদের বিলাপ, কান্না আর আর্তনাদে করুণ দৃশ্য ছিল ঢামেক জুড়ে।
উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ছিল নার্গিসের: নার্গিস আক্তার। মাত্র ১৩ দিন হলো গার্মেন্টসে কাজ শুরু করেছিলেন। গত বছর মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করেন। স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষার। কিন্তু বাবার অভাবের সংসারে আর পড়া হয়নি তার। যোগ দেন গার্মেন্টসে। কিন্তু আগুনে পুড়ে নিভে যায় তার সব স্বপ্ন। নার্গিসের বাবা মো. ওজুউল্লাহ দোকানদারি করতেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সী নার্গিস ছিলেন চার বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। সংসারের হাল ধরতে বাবার নিষেধ অমান্য করে পোশাক কারখানাটিতে যোগ দেন তিনি। ওই কারখানা সংলগ্ন রাসায়নিকের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে মারা যান নার্গিস। রাত তিনটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে তার মরদেহ শনাক্ত করেন পরিবারের সদস্যরা। বুধবার সকাল ৯টার দিকে ঢামেকের জরুরি বিভাগের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন ছোট বোন মৌসুমী। তিনি বলেন, আমার মেজো আপুটা সকালে কাজে যেত, রাতে ফিরতো। ফোন ব্যবহার করতো না। কথা বলারও সুযোগ পেতাম না। গতকাল ছিল তার চাকরিতে যোগ দেয়ার ১৩ দিন। কিন্তু সে আর ফিরলো না। তিনি বলেন, আমার বোন বেকার বসে থাকেনি, আমাদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চেয়েছিল। এখন আমাদের কী হবে? তার মরদেহ ভোলার লালমোহনের দক্ষিণ বেদিরিয়া গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে। নার্গিসের বাবা মো. ওজুউল্লাহ্ বলেন, ওর পড়াশোনা চালাতে পারিনি। বলেছিল, কাজ করবে, সংসারে সাহায্য করবে। কিন্তু আজ কী হয়ে গেল।
বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখতে গার্মেন্টসে চাকরি নেন খালিদ: গার্মেন্টসে এডমিন শাখায় কাজ করতেন খালিদ হাসান (২৮)। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে সন্তান। কিন্তু আগুনে পুড়ে যায় সে। এখনো লাশ শনাক্ত করতে পারেনি স্বজনেরা। খালিদের চাচা মোজাম্মেল হোসেন ছবি নিয়ে ঢামেকের মর্গে ঘুরছেন। তিনি বলেন, খালিদকে খুঁজছি কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না। কোথায় গেলে তাকে পাবো? কিছুই বুঝতে পারছি না। এখনো লাশের সন্ধান পাইনি। এখন ডিএনএ টেস্টের পরে বোঝা যাবে। তিনি বলেন, ঘটনার সময় আমি মিরপুর ১৪ নম্বরে ছিলাম, সেখান থেকে শুনে ছুটে আসি। সেখানে খালিদকে না পেয়ে রাতে ঢাকা মেডিকেলে মর্গে এসে লাশগুলো দেখি, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না পুড়ে গেছে। ডিএনএ ছাড়া লাশ শনাক্ত করা যাবে না। একজনকে দেখে মনে হয় এই আমাদের খালিদ। সে গার্মেন্টসের এডমিনে ছিল। পহেলা সেপ্টেম্বর চাকরি নিয়েছে। বরগুনা সদরে আমাদের বাড়ি। এর আগে অন্য জায়গা কাজ করতো। আমি এবং আমার ভাই সাবেক সেনা সদস্য। খালিদ ছিল একমাত্র ছেলে। তিন বছর আগে বিয়ে করে। বাবা-মায়ের বয়স হয়ে যাওয়ায় সে ঢাকায় এসে চাকরি শুরু করেছিল। এখন ওদের বাবা-মাকে কে দেখবে, কে দেবে তাদের সান্ত্ব্তনা।
চৌদ্দ বছর বয়সী আসমা আক্তার। তিনি কাজ করতেন গার্মেন্টসে। তার বাবা নয়ন মাছ ধরে সংসার চালাতেন। কিন্তু আগুনের ঘটনায় শেষ হয়ে গেল আসমার জীবন। আসমার খালাতো বোন জাকিয়া বলেন, আমার বোনকে আমরা শনাক্ত করেছি। এখনো ডিএনএ টেস্ট করেনি। বোনের যে জামাটা পরে অফিসে এসেছিল সেই জামা পড়ে ছবি তুলেছিল। অনেক সুন্দর ছিল আমার বোন, পুড়ে গেছে। কতো কষ্ট হয়েছিল, কতো কষ্ট পেয়ে মারা গেছে। তিনি বলেন, রমজানের ঈদে বাড়িতে গিয়েছিল আর যায়নি। এই রোববার বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু হয়নি। এখন বিয়ে হয়নি আসমার। এক নজর বোনকে দেখার জন্য সারারাত ঘুমাইনি। মিরপুরে আমার মায়ের কাছে থেকে আসমা চাকরি করতো। ওরা চার বোন দুই ভাই। সংসারে অভাবের কারণে আসমা চাকরি করতে এসেছে ঢাকায়। আসমার মা অসুস্থ। ওর একটা ছোট ভাইয়ের কিডনিতে সমস্যা। যে গার্মেন্টসে কাজ করতো সেটি বাইরে থেকে তালা মেরে দিয়েছিল। ঘটনার পর আমার মা ফোন দিয়ে জানায় আগুন লেগেছে।
ফারজানা আক্তার (১৫)। পরিবারের আর্থিক সমস্যা থাকায় ছয়মাস আগে এই গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছিল। তারা ছয় ভাই-বোন ছিলেন। সুনামগঞ্জ গ্রামের বাড়ি। মিরপুরে বাবার সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকতেন। বাবা বয়সের কারণে কিছুই করতে পারেন না। ঘটনার দিন সকাল আটটার সময় বাসা থেকে বের হয়। ফারজানার কাছে কোনো মোবাইল ছিল না, ওর এক বান্ধবী আমাদের জানায়। রাতে মেয়ের মুখ দেখে শনাক্ত করেছি। সকালে আমাদের আসতে বলেছিল। এখন ডিএনএ টেস্ট করে মরদেহ নেয়া হবে। ফারজানার চুল ও নাক-মুখ পুড়েছে বেশি, বাকি সব ঠিক আছে। যে জামা পরে ছিল সেটি কিছুই হয়নি তেমন। মেয়েকে অভাবের কারণে লেখাপড়া করাতে পারিনি। বাকি চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। অনেক আগে থেকে শারীরিকভাবে অসুস্থ আমি। এই মেয়ে যে টাকা বেতন পেতো সেটি দিয়ে সংসারে খরচ করতো। ৮০০০-৯০০০ টাকা বেতন পেতো।
খোঁজ মিলছে না মৌসুমি-মুক্তার: মিরপুরে আগুনের ঘটনায় এখনো কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে দাবি করেছেন অনেক ভুক্তভোগী পরিবার। বুধবার ঢামেকের জরুরি বিভাগের সামনে ঘটনার পর থেকে অপেক্ষা করছেন নিখোঁজদের স্বজনরা। পরিবারগুলো তাদের প্রিয়জনদের এখনো খুঁজে ফিরছেন পাগলের মতো। হাসপাতালের মর্গে মর্গে ছুটছেন লালমনিরহাটের আব্দুল মান্নান। তার মেয়ে মৌসুমি আক্তারকে খুঁজছেন তিনি। মৌসুমি এসএসসি পাসের পর টাকার অভাবে আর পড়াশোনা করতে না পারেননি। তিনি অভাবের সংসারে কাজের সন্ধানে ছুটে আসেন ঢাকায়। মাত্র এক মাস আগে গার্মেন্টসে কাজ শুরু করেছিলেন। থাকতেন বাবার সঙ্গে। আব্দুল মান্নান বলেন, যখন আগুন লাগার খবর পাই তখনই রিকশা গ্যারেজে রেখে ছুটে আসি। মেয়ের খোঁজে সারা দিন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছি। একে একে লাশ বের হতে দেখি, কিন্তু কোথাও আমার মেয়েকে পাইনি। এখন এখানে ঢামেকে এসেছি। ভেবেছি হয়তো ও এখানে আছে। যদি এখানেও না পাই, তাহলে কোথায় খুঁজবো আমার মেয়েকে?
এদিকে মুক্তার নামে আরেক নারীর খোঁজে এসেছেন পরিবার। তার তিন সন্তান রয়েছে। মুক্তার ভাই আব্দুল দেওয়ান বলেন, আমার বোনের বয়স ৩৫ বছর। তার তিন সন্তান রয়েছে। কয়েক মাস ধরে বেকার থাকার পর দেড় মাস আগে ওই পোশাক কারখানায় চাকরি পেয়েছিলেন। এখন তিনি নিখোঁজ। তিনি বলেন, গতকাল দুপুর থেকে আজ এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ঘুরছি। মুক্তার কোনো খোঁজ নেই। ওর তিন সন্তান মায়ের জন্য কাঁদছে।
দীর্ঘদিন ধরে ওই পোশাক কারখানায় চাকরি করেন নাজমুল ইসলাম। তার দুই সন্তান রয়েছে। পরিবার নিয়ে ঢাকার মিরপুরে বসবাস করতেন। বেলা তিনটায় জরুরি বিভাগের সামনে দেখা যায় তার স্বজনদের আর্তনাদ করতে। এসময় তার শ্যালক মো. ইয়াসিন বলেন, আমার দুলাভাই ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ১১টায় আমার বোনের কাছে ফোন দিয়েছিল। তখন তিনি বলেন “আগুন লেগেছে, মনে হয় বাঁচবো না।” এরপর থেকে তাকে মোবাইলে আর পাওয়া যায়নি। কিছুক্ষণ মোবাইল খোলা থাকলেও এরপর বন্ধ। এখন পর্যন্ত আর মোবাইলে কল যাচ্ছে না। আমরা মর্গে মর্গে খুঁজেছি। এখন ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে শনাক্ত করতে হবে।
মঙ্গলবার দুপুরে মিরপুরে শিয়ালবাড়ির ৩ নম্বর সড়কের একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগে। গুদামে বিস্ফোরণের পর আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের চারতলা ভবনে। পরে ভবনের দোতলা ও তিনতলা থেকে ১৬টি লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। নিহত ব্যক্তিদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেক হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।