
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। এগুলো মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে নানামুখী কৌশল গ্রহণ করছে বিএনপি। কৌশল বাস্তবায়নে লন্ডন থেকে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
সূত্র মতে, বিএনপির সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে- ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন, ভোটের আগে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা, শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান বজায় রাখা, দলের প্রার্থী চূড়ান্ত করা, সমমনা দলগুলোর সমর্থন অব্যাহত রাখা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গে সম্পর্ক, জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারসহ আরও কিছু চ্যালেঞ্জ। তবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিএনপিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর বেশি সময় বাকি নেই। মাত্র চার মাস পরই হচ্ছে এ নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো যে যার মতো করে নির্বাচনের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনও দ্রুত গতিতে নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করতে সক্রিয় রয়েছে।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমভাগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার ঘোষণা আগেই দিয়ে রেখেছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েও ওই সময়ে নির্বাচনের জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে বলেছেন। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাই এ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিকে বেশ ক’টি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে সব সময়ই নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই সামনে এগিয়ে যেতে হয়। বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আসছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির সামনে যত রকমের চ্যালেঞ্জ আছে তা মোকাবিলা করেই আমরা এগিয়ে যাব। দেশে ভোটের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকে সঙ্গে নিয়ে যা যা করার তা আমরা করব।
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি হবে না তা নিয়ে দেশে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও বিএনপি মনে করে ঘোষিত সময়েই নির্বাচন হবে। এ জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি জোরদার করছে দলটি। সেই সঙ্গে ঘোষিত সময়েই যাতে নির্বাচন হয় সে জন্য সরকার ও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হচ্ছে বিএনপি হাইকমান্ডকে।
আগের তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের সাধারণ মানুষ ভোট দিতে না পারায় এবার যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় সেজন্য নানামুখী চেষ্টা-তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। নির্বাচনে সকল দলের জন্য যেন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হয় সে জন্য বার বার সরকার ও নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
ক’টি রাজনৈতিক দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়ে এখনো অনড় অবস্থানে থাকলেও বিএনপি চায় প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন। এ জন্য ইতোমধ্যেই দলের পক্ষ থেকে পিআর পদ্ধতির ভুলত্রুটি জনসমক্ষে তুলে ধরেছে দলটি। সেইসঙ্গে যেসব দল পিআর পদ্ধতির নির্বাচন চায় তাদের তা নির্বাচনী ইশতেহারে রাখার কথা জানিয়ে নির্বাচনের পর আইনী ভিত্তিতে এ পদ্ধতি চালু করার প্রস্তাব করেছে বিএনপি। তার পরও ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতিতে করার চেষ্টা হলে বিএনপি তা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করবে বলে জানা যায়।
সূত্র মতে, ভোটের আগে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা বিএনপির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। অতীতে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনের আগে বিভিন্নভাবে বিএনপিতে অনৈক্য সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলেও এবারও কোনোভাবে সে চেষ্টা করা হয় কি না সে বিষয়ে দলীয় হাইকমান্ড সতর্ক রয়েছে।
৫ আগস্টের পর থেকে দলের কিছু নেতাকর্মী বিচ্ছিন্নভাবে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে বিএনপি কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে। তবে যখন যেখানে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ পাওয়া গেছে তদন্ত সাপেক্ষ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে। এ পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভোটের আগ পর্যন্ত শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান বজায় রাখা বিএনপির সামনে একটি চ্যালেঞ্জ।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের প্রার্থী চূড়ান্ত করা বিএনপির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এখনো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা না হলেও বিভিন্ন সংসদীয় আসনে একাধিক প্রভাবশালী প্রার্থী মাঠে নির্বাচনী প্রচারে সক্রিয় থাকায় কখনও কখনও নিজেদের মধ্যে বিরোধ তৈরী হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় দীর্ঘদিন ত্যাগী নেতারা নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় থাকলেও এখন হঠাৎ করে দলের নাম করে নতুন নতুন সম্ভাব্য প্রার্থী এলাকায় শোডাউন শুরু করে। এ নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীরাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছে। আবার কোনো আসনে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা রাজনেতিক দলের প্রার্থীরাও জোরেশোরে নির্বাচনী প্রচারে নেমেছে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে। এ পরিস্থিতিতে এবার ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে বিএনপিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে সূত্র জানায়।
দীর্ঘদিন একসঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা প্রায় ৪০টি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে নির্বাচন করতে চায় বিএনপি। তাদের কিছু আসনও ছাড়তে চায়। তবে কোনো কোনো মহল এই সমমনা দলগুলোকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে নানামুখী চেষ্টা চালাচ্ছে। আবার চাহিদা মতো আসন না না পেয়ে কোনো কোনো সমমনা দল বিএনপির প্রতি ক্ষুব্দ হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত সমমনা দলগুলোর সমর্থন অব্যাহত রাখা বিএনপির জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করাও বিএনপির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দীর্ঘ ১৯ বছর পর নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যেতে পারলে বিএনপিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের জোরালো সমর্থন প্রয়োজন হবে। এ জন্য ভোটের আগেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কৌশলী হতে হচ্ছে। কোনো কারণে কোনো আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গে যেন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয় সেজন্য নানামুখী হিসেব নিকেশ করে পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ইতোমধ্যেই বিভিন্ন কর্মসূচিতে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থেকে ধানের শীষে ভোট চাইতে বলেছেন। নির্বাচন ঠেকাতে নানামুখী ষড়যন্ত্র হচ্ছে জানিয়ে এ ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে নেতাকর্মীদের সজাগ ও সতর্ক থেকে সবাইকে মাঠে সক্রিয় থাকতে বলেছেন। দেশের সর্বস্তরের মানুষের আস্থা অর্জন করতে যা যা করনীয় তা করতেও বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপির জন্য এতো সহজ হবে না, এ বিষয়টি মাথায় রেখে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে কাজ করতে হবে।
তারেক রহমান বলেন, সামনে অনেক কাজ, অনেক চ্যালেঞ্জ। দেশের মানুষ বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে বিএনপিকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আর আমাদের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। না হলে আমরা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারব না। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ জনগণের আস্থা অর্জন করে রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা বাস্তবায়ন করা।