Image description
 

জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব সালেহ উদ্দিন সিফাত সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্টে জুলাই সনদ ও তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরেছেন।

 

সিফাত লিখেছেন,

জুলাই ফিরে আসছে… জুলাই অভ্যুত্থানে জনগণের ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’র বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়ে একটি ফ্যাসিবাদী তথাপি ‘সাংবিধানিক’(!) সরকারকে ‘অসাংবিধানিক’(!) কায়দায় উৎখাত করেছে ছাত্র-জনতা। যা আদতে ছিল জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের বৈধ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ৫ তারিখের পর থেকে অদ্যাবধি 'স্থিতিশীলতা' এবং ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’র নামে জনগণের ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’র চরম বহিঃপ্রকাশ এবং নতুন সাংবিধানিক অগ্রযাত্রাকে বারবার নানা জোঁড়াতালি ও ছলচাতুরির আশ্রয়ে বাহাত্তরের স্থবির ‘সাংবিধানিক কাঠামো’র মধ্যে আঁটানোর চেষ্টা চলমান রয়েছে। এই ধারাবাহিক জোঁড়াতালি অদূর ভবিষ্যতে অভ্যুত্থানকে ‘অসাংবিধানিক’ এবং অভ্যুত্থানের নেতাদের ‘সংবিধান লঙ্ঘনকারী’ হিসাবে সাব্যস্ত করার আইনী ফাঁদ রেখে যাচ্ছে। যার সাজা বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী সাফ মৃত্যুদণ্ড।

 

তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থান, এর সকল শহীদ ও আহতযোদ্ধা এবং, ইন্টেরিম সরকারের আইনগত স্বীকৃতির জন্য ছাত্র-জনতাই জুলাই ঘোষণাপত্রের দাবিতে মাঠে সর্বদা সক্রিয় ছিল। এমনকি সরকার ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর নিরবতায় ত্যক্ত হয়ে নিজেরাই 'জুলাই ঘোষণাপত্র' ঘোষণায় উদ্যোগী হয়েছিল। এই গণচাপের ফলে ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে এবং উপস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেছিলেন। বলা বাহুল্য, এই ঘোষণাপত্র বা Declaration (Proclamation নয়) নব্বইয়ের 'তিনজোটের রূপরেখা'র ন্যায় স্রেফ একটি রাজনৈতিক সমঝোতার দলিলে পর্যবসিত হয়েছে। এর কোনো আইনী ভিত্তি (Legality) দেওয়া হয়নি। আমরা দ্বিতীয়বার হতাশ হলাম।

 

পোস্টে তিনি আরও উল্লেখ করেন, ঐক্যমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনা শেষে গতকাল রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ‘জুলাই সনদ' - এর খসড়া পাঠানো হয়েছে। আমরা বারবার বলেছি - অভ্যুত্থান পরবর্তী যেকোনো বন্দোবস্তের নৈতিক (Legitimacy) ও আইনী (Legality) ভিত্তি হতে হবে জনগণের ‘সার্বভৌম ও গাঠনিক ক্ষমতা’। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় - জুলাই সনদে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিভাত জনগণের ‘সার্বভৌম ও গাঠনিক ক্ষমতা’ সম্পর্কিত এই মৌলিক সত্যের কোনো উল্লেখ নাই। 

পোস্টে তিনি আরও উল্লেখ করেন, সনদ বাস্তবায়নের একটি প্রক্রিয়া হিসাবে সকল রাজনৈতিক দল ‘গণভোট’ - এ  সম্মত হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী গণভোট নিজেই ‘অসাংবিধানিক’। অপরদিকে, জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানের এমন কিছু অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে, যা বিদ্যমান সংবিধানের তথাকথিত ‘বেইসিক স্ট্রাকচার’ এর আওতাভূক্ত। যেমন: মূলনীতিসহ প্রথম ভাগের পরিবর্তনের প্রস্তাবসমূহ। ফলে বাহাত্তরের সংবিধানের অধীনে থেকে খোদ এর ‘বেইসিক স্ট্রাকচার’কে লঙ্ঘন করে সংবিধান সংশোধন বা সংস্কার করার কোনো আইনী বৈধতা নাই। তাই গণভোট এবং পরবর্তী সংসদের মধ্য দিয়ে এই ধরণের সংস্কার আনলেও অদূর ভবিষ্যতে এটি আদালতে চ্যালেঞ্জড এবং বাতিল হওয়া অনিবার্য। কাজেই এই প্রক্রিয়ায় ‘জুলাই সনদ’ পাশ হলে, এটি জনগণের সাথে একটি সাংবিধানিক প্রতারণা বৈ কিছু হবে না।  একারণেই আমরা গণভোটের পূর্বে একটি সাংবিধানিক আদেশ (Constitutional Order) জারির কথা বলেছি। যার টেক্সটেই এর নৈতিক ও আইনী ভিত্তি স্পষ্ট উল্লেখ থাকবে। তথা, এই আদেশের নৈতিক (Legitimacy) ও আইনী (Legality) ভিত্তি গণঅভ্যুত্থান থেকে উৎসারিত। জুরিস্প্রুডেনশিয়ালি স্পিকিং, নানা আইনী গোঁজামিলের কারণে বেইসিক স্ট্রাকচার সমেত বিদ্যমান নিশ্চল সংবিধানই ‘সুপ্রিম ল অব দ্যা ল্যান্ড’। ফলে এর মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন বা সংস্কারের জন্য এর চেয়েও বড় লিগ্যাল ম্যান্ডেট প্রয়োজন। আর তা গণঅভ্যুত্থান থেকেই উৎসারিত। ফলে রাষ্ট্রপতি এই আদেশ জারি করতে পারবেন না। (যদিও সরকার প্রধান আর রাষ্ট্রপ্রধানে মিলিয়ে ফেলায় আমি নিজেই এক জায়গায় রাষ্ট্রপতির আদেশের কথা বলেছি) এই আদেশ ‘জনগণের ইচ্ছা’র দ্বারা সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনুসকেই জারি করতে হবে। কারণ, তিনিই এই সরকারের প্রধান এবং এ ধরণের আদেশ রাষ্ট্র প্রধান নন; বরং সরকার প্রধানই দেন। সাংবিধানিক সংস্কার ও গঠনের (সংশোধন নয়) জন্যই যে এই আদেশ, তা তাতে স্পষ্টভাষায় লিখিত থাকতে হবে। 

তিনি আরও বলেন, যেখানে আলোচনার বিষয়বস্তু হওয়া উচিত ছিল - জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনী (Legality) ভিত্তি তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে; সেখানে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াত এবং ঐক্যমত্য কমিশনের তর্ক গিয়ে ঠেকেছে - "গণভোট নির্বাচনের দিন হবে নাকি আগে?" যদিও বেইসিক স্ট্রাকচার ক্ষুন্নকারী 'সাংবিধানিক সংস্কার'সমূহ বাস্তবায়নে 'গণভোট' পদ্ধতি মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো প্রকারন্তরে মেনে নিয়েছে - The People is above the Constitution itself; কিন্তু কোনো এক অদ্ভূত কারণে এই কথাটাকেই আইনী ভাষা ও বয়ানে বলতে পিছু হটছেন তারা। 

উপরোক্ত আদেশের অধীনেই গণভোট এবং ফেব্রুয়ারীতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। উক্ত নির্বাচনে নির্বাচিত সভা একইসাথে গণপরিষদ এবং নিয়মিত সংসদের ভূমিকা পালন করবে। এর প্রথম কাজ - গণভোটে জনরায়ের দ্বারা অনুমোদিত সাংবিধানিক সংস্কারসমূহকে গণপরিষদের মধ্য দিয়ে নতুন করে গঠন করা। এই আদেশ জারি ব্যতিরেক নিছক জুলাই সনদের ঘোষণা জনগণের সাথে আরেকটি প্রতারণাই হবে। জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। নতুবা, নানা জোঁড়াতালি দিয়ে এবং আইনী ফাঁদ রেখে জনগণের 'সার্বভৌম ও গাঠনিক ক্ষমতা'কে বাহাত্তরের সংবিধানে বাক্সবন্দি করে জনগণের সাথেই প্রতারণায় কারোই অংশীদার হওয়া উচিত হবে না বলে আমি মনে করি। নির্বাচন ফেব্রুয়ারীতেই অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু বারবার  জোঁড়াতালি এবং 'আইনী ফাঁদ' রেখে না।