
মানি লন্ডারিং (অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থের অবৈধ উৎস গোপনের মাধ্যমে তা বৈধ করা বা বৈধের চেষ্টা) ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তদের অর্থায়ন বন্ধে ১৩টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে এর আগে চিহ্নিত ১০টি দেশ কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং ও চীনের সঙ্গে পারস্পরিক আইনি সহায়তা চুক্তি (এমএলএ ট্রিয়েটি) স্বাক্ষরের বিষয়টি এগিয়ে নিতে বলা হয়। সাম্প্রতিক চিহ্নিত অর্থ পাচারের গন্তব্য ট্যাক্স হেভেন (যেসব দেশে বিদেশিদের ট্যাক্সের পরিমাণ কম) হিসেবে পরিচিত দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গেও এ ধরনের চুক্তি করার উদ্যোগ নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর হওয়া এ-সংক্রান্ত ওয়ার্কিং কমিটির ২৬তম সভায় সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারক। সভার কার্যবিবরণী থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
ওয়ার্কিং কমিটির সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিং (এপিজি) কর্তৃক মিউচুয়াল ইভ্যালুয়েশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে জাতীয় সমন্বয় কমিটির ১৯তম সভায় গৃহীত কর্মপরিকল্পনা সংবলিত ৯৯টি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে সভায়। অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো চিহ্নিত করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠাতে বলা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ছাড়া অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় নিজস্ব প্রসিকিউশন সার্ভিস না থাকায় দেশে মানি লন্ডারিং মামলার নিষ্পত্তির হার কম বলে সভায় আলোচনা হয়। এজন্য দুদকের মতো অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে মানি লন্ডারিং মামলার ক্ষেত্রে নিজস্ব প্রসিকিউশন সার্ভিস চালুর বিষয়ে আলোচকরা তাদের মতামত তুলে ধরেন। তবে এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্তের প্রয়োজন বলে সবাই একমত পোষণ করেন।
এ ছাড়া আগামী ২০২৭-২৮ সালে বাংলাদেশে এপিজির চতুর্থ পর্বের মিউচুয়াল ইভ্যালুয়েশন উপলক্ষে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন-সংক্রান্ত জাতীয় ঝুঁকি নিরূপণ প্রাধিকারভিত্তিতে দ্রুততার সঙ্গে সম্পাদনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে ২০২৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য পাঠানোর জন্য সভা থেকে বলা হয়েছে। সন্ত্রাসে অর্থায়ন ঝুঁকি নিরূপণ, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন-সংক্রান্ত ঝুঁকি নিরূপণ-সংক্রান্ত কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য ওয়ার্কিং কমিটির পরবর্তী সভায় টিএফ রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট কমিটির আহ্বায়ককে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়ে কর্মকর্তারা একমত হয়েছেন।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারক বলেন, ওয়ার্কিং কমিটি মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধ এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে নিয়মিত ওয়ার্কিং কমিটির সভা আয়োজনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
১৪ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নির্দেশ: ১. ২০১৬ সালের মিউচুয়াল ইভ্যালুয়েশন রিপোর্টে এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) সুপারিশগুলো পরিপালনে জাতীয় সমন্বয় কমিটি অনুমোদিত কর্মপরিকল্পনাগুলোর মধ্যে অবাস্তবায়িত কর্মপরিকল্পনাগুলো চিহ্নিত করে হালনাগাদ তথ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠাতে হবে।
২. আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে অবাস্তবায়িত কর্মপরিকল্পনাগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থাগুলোর নির্দেশনা দেবে। প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে আলাদাভাবে সভা করতে হবে।
৩. মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নে দেশের ঝুঁকি নিরূপণ-সংক্রান্ত তৃতীয় ন্যাশনাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট (এআরএ) কার্যক্রম সম্পন্নের জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থা ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত তথ্য পাঠাবে।
৪. হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহের পর এনআরএ কার্যক্রম দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করতে হবে।
৫. বাংলাদেশের মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ ব্যবস্থা মূল্যায়নে এপিজি কর্তৃক আগামী ২০২৭-২৮ মেয়াদে মিউচুয়াল ইভ্যালুয়েশন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের লক্ষ্যে একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করে জাতীয় সমন্বয় কমিটিতে উপস্থাপন করতে হবে।
৬. সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন এবং ঝুঁকি নিরুপণের বিষয়ে গঠিত টিএফ রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট-সংক্রান্ত কমিটির আহ্বায়ক বা সভাপতিকে ওয়ার্কিং কমিটির পরবর্তী সভায় অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৭. কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর সংশোধনীর বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে হবে।
৮. দ্য পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৯৬৭ সংশোধনের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।
৯. পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে ১০টি দেশের সঙ্গে দ্রুততম সময়ে এমএলএ ট্রিয়েটি বা এগ্রিমেন্ট সম্পন্নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এমএলএআর প্রস্তুত করতে হবে।
১০. অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে দ্বীপরাষ্ট্র ও ট্যাক্স হেভেন রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে এমএলএ এগ্রিমেন্ট করার বিষয়টি যাচাইপূর্বক নীতিগত সিদ্ধান্তের জন্য জাতীয় সমন্বয় কমিটিতে উত্থাপন করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বিএফআইইউকে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে।
১১. এমএলএ রিকোয়েস্ট পাঠানো ও পরবর্তী কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তদন্তকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তদন্তকারী সংস্থাগুলো সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করবে।
১২. সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থাগুলো তাদের পদভিত্তিক প্রাইমারি কন্টাক্ট পারসনের হালনাগাদ তথ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বিএফআইইউ বরাবর পাঠাবে। বিএফআইইউ প্রাইমারি কন্টাক্ট পারসনের হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণ করবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থা, বিএফআইইউ এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবে।
১৩. মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর আওতায় দাখিল করা মামলার পরিসংখ্যান বিষয়ক ছকটি তদন্তকারী সংস্থাগুলো কর্তৃক পর্যালোচনাপূর্বক প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংশোধনের প্রস্তাব পাঠাবে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, তদন্তকারী সংস্থাগুলো ও বিএফআইইউ।
১৪. মানি লন্ডারিংয়ের তদন্ত ও প্রসিকিউশন বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন অব্যাহত রাখতে হবে এবং প্রশিক্ষণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ যৌথ তদন্ত দলের সদস্যদের রাখতে হবে। বিএফআইইউ এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।