Image description
প্রশাসন ও ভোটের কার্যক্রম

প্রশাসন ও ভোটের কাজে একটি বিশেষ দলের লোকদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছে বিএনপি। তাই জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দলটি। সোমবার রাতে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন নেতারা। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে ফিরলে এ নিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। পাশাপাশি দু-একদিনের মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনে যাবেন দলটির একটি প্রতিনিধিদল। সেখানে এ বিষয়গুলো প্রধান উপদেষ্টা ও কমিশনকে অবহিত করার পাশাপাশি তাদের উদ্বেগের কথা জানাবেন। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানও জানাবেন। এছাড়া জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে বিএনপি। তবে এর আগে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে পাঠানো চূড়ান্ত জুলাই সনদ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখছে দলটি। বিএনপি যা বলেছে, সেখানে যদি তা থাকে, তাহলে স্বাক্ষর করবে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন নেতা যুগান্তরকে বলেন, কিছু কিছু উপদেষ্টার বক্তব্য, তৎপরতা ও কার্যক্রম সরকারের নিরপেক্ষতাকে ক্ষুণ্ন করছে। প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল-পদায়ন নিয়ে কিছু উপদেষ্টা পক্ষপাতমূলক আচরণ করছেন, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে কাজ করছেন। এছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে মাঠপর্যায়ে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার যে প্যানেল প্রস্তুত করা হচ্ছে, সেখানেও জামায়াতে ইসলামীর লোকদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। যার তথ্য বিএনপির কাছে রয়েছে। এসব ঘটনায় তারা উদ্বিগ্ন। একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থেই সরকারের উচিত নিজেদের নিরপেক্ষ রাখা। এ লক্ষ্যে এখনই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো করে তাদের চরিত্র দাঁড় করানো প্রয়োজন, যাতে সরকার ও প্রশাসনের শতভাগ নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হয়।

নির্বাচন সামনে রেখে চলতি অক্টোবরের মধ্যেই ‘ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেল’ প্রস্তুত রাখতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ লক্ষ্যে গত ২ সেপ্টেম্বর সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়, আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় প্যানেল প্রস্তুত করতে হবে। এ জন্য সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক-বিমা থেকে শ্রেণি বা গ্রেডভিত্তিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা সংগ্রহ করতে হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে নেতাদের অভিমত, সারা দেশে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার যে প্যানেল প্রস্তুত করা হচ্ছে, সেটার অধিকাংশ কর্মকর্তা ছাত্রজীবনে ছাত্রশিবির এবং বর্তমানে জামায়াতপন্থি। এমনটা হলে নির্বাচনে তারা একটা বিশেষ দলকে বিজয়ী করতে ভূমিকা রাখতে পারে। এতে করে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই সতর্কভাবে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে যাতে এই তালিকা প্রণয়ন করা হয়, সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এ লক্ষ্যে শিগগিরই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাবে বিএনপি। নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সব কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা চায় দলটি।

সূত্র জানায়, বৈঠকে নেতারা বলেন, ৫ আগস্টের পরে প্রশাসনিক যে রদবদল বা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে, সেখানে একটি দলের লোকজনকে অধিকাংশ জায়গায় ঠাঁই দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নেতারা। তারা বলেছেন, নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনিক যে নিরপেক্ষতা, তা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য তাদের দৃশ্যমান সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে হবে। বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা মনে করছেন, বিগত ১৬ বছরের যে ফ্যাসিবাদী সরকার, তাদের যে প্রশাসন- সেখান থেকে তাদের লোকজনকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে সরানো হয়নি; একইসঙ্গে আরও একটি বিশেষ দলের লোকজনকেও নতুন করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসানো হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের নিয়োগ দেওয়া লোকজনকে শেল্টারও দিচ্ছে ওই দলটি।। এ বিষয় নিয়ে বৈঠকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। জুলাই সনদ এখন স্বাক্ষরের পর্যায়ে রয়েছে। বিএনপি এই সনদে স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আগামী ১৭ অক্টোবর সনদ স্বাক্ষরের দিন শতাধিক নেতার সমন্বয়ে গঠিত বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগদান করবে। আর দলের পক্ষ থেকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বহুল আলোচিত জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবেন।

এছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে গণসংযোগের প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা হয় বৈঠকে। মাঠপর্যায়ে তাদের যে প্রচার-প্রচারণা রয়েছে, সেখানে ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করছে দলটি। এ ক্ষেত্রে প্রচারণায় আরও কীভাবে গতি আনা যায়, এ লক্ষ্যে দলের মিডিয়া সেল ও কমিউনিকেশন সেলকে কিভাবে আরও সক্রিয় এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাজে লাগানো যায়, সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এছাড়া বিএনপির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে নানামুখী অপপ্রচার চলছে, নতুন নতুন ন্যারেটিভের মাধ্যমে সেটাকে কিভাবে অ্যাড্রেস করা যায়, আলোচনা হয়েছে তা নিয়েও। একইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দলের প্রচার-প্রচারণা আরও জোরদার করার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে বৈঠকে।

স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপির প্রার্থিতা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা না হলেও এটা দলের একটা চলমান প্রক্রিয়া। স্থায়ী কমিটি বেশ আগেই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ওপর এ বিষয়টির দায়িত্ব দিয়েছে এবং তিনি এ ব্যাপারে শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেবেন।

জানা গেছে, বৈঠকে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নেতারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা এমন সব কথা বলছেন, কার্যক্রম করছেন- যাতে তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে এই সরকার তাদের নিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলুক কিংবা এটা নিয়ে নতুন করে কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হোক, সেটা তারা চান না। নেতারা মনে করেন, যেহেতু নির্বাচন আসন্ন এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করাই সরকারের লক্ষ্য। সুতরাং সেই নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত নিজেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে সাজানো- যাতে প্রশাসনিক বা সিদ্ধান্তগ্রহণমূলক কোনো কাজ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে।