Image description

ব্যাংকের টাকা লুটে নিয়ে যাঁরা লাপাত্তা তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ যাঁরা সৎ ও প্রকৃত গ্রাহক তাঁদের ‘ইচ্ছাকৃত’ ঋণখেলাপির তালিকায় রাখা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর তৈরি তালিকায় এ রকম অসংগতি ধরা পড়েছে।

প্রকৃত খেলাপি যাচাই না করেই তালিকা পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে।

এতে অনেক প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তা, যাঁরা প্রকৃত অর্থে ব্যাবসায়িক ব্যর্থতা বা বাহ্যিক কারণে ঋণ শোধে অক্ষম হয়েছেন, তাঁদের ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে প্রকৃত ইচ্ছাকৃত খেলাপি—যাঁরা পর্যাপ্ত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করছেন না বা ভিন্ন খাতে অর্থ সরিয়ে নিয়েছে—তাঁদের অনেকে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। ফলে নিরপরাধরা অপরাধী হয়ে যাচ্ছেন, আর প্রকৃত অপরাধীরা দায়মুক্তি পাচ্ছেন। তাই ‘ইচ্ছাকৃত’ ঋণখেলাপিদের তালিকা তৈরির নির্দেশনা বাতিল করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহকের সংখ্যা তিন হাজার ৪৮৩। তাঁদের পেটে আটকে আছে ২৮ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংককে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা তৈরি করে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা আনা, খেলাপিদের নতুন ঋণ বা সুবিধা বন্ধ করা এবং প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যাংকগুলোর নিজস্ব স্বার্থ এবং তথ্য যাচাইয়ের দুর্বলতার কারণে প্রক্রিয়াটি কার্যকর হয়নি, বরং নতুন করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম একটি স্বচ্ছ তালিকা, কিন্তু ব্যাংকগুলো ভুল তথ্য দিয়েছে। এতে কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হচ্ছে। তাই প্রক্রিয়াটি স্থগিত বা বাতিলের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ পরিদর্শনে উঠে এসেছে তথ্য গোপন ও খামখেয়ালির চিত্র।

২০২৫ সালের ৬ জানুয়ারি রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংককে ইনটেনসিটি লিমিটেডকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কারণ সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করছে না প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু সেই নির্দেশনা আমলে নেয়নি ব্যাংকটি। অর্থাৎ ব্যাংকটি পক্ষপাতিত্ব করেছে। কিন্তু ব্যাংকের স্বার্থে একজন খারাপ গ্রাহককে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি দেখানোর কথা ছিল। এ কারণেই আইনটি বাতিল করা দরকার বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আরো দুঃখজনক বিষয় হলো, সম্প্রতি ইনটেনসিটি লিমিটেডকে স্বল্প ডাউন পেমেন্টে ঋণ পুনঃ তফসিল করার জন্য নীতি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। শুধু এই একটি প্রতিষ্ঠান নয়, দেশবন্ধু গ্রুপসহ আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী অনেক প্রতিষ্ঠানকেই নীতি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আওয়ামী সরকারের পতন হলেও নতুন করে চেয়ার পাওয়াদের মধ্যে বহু ব্যাংকার এখানো ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন।

 

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ গোপন করার প্রবণতা বহুদিনের। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণেও সেই অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। গ্রাহকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা প্রভাব খাটিয়ে প্রকৃত খেলাপি নন এমন অনেককেই ইচ্ছাকৃত খেলাপি দেখানো হচ্ছে। আবার এস আলম গ্রুপের মতো প্রভাবশালী বড় ঋণখেলাপিদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এতে প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ না হয়ে বরং পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক সবার প্রতি এক দৃষ্টিতে খেলাপিদের চিহ্নিত করতে চাইছে, যাতে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত হয়।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গৃহীত ‘ব্যাংক কম্পানি অ্যাক্ট (সংশোধীত) ২০২৩’-এর মাধ্যমে মূলত দলীয় নেতাকর্মীদের নেওয়া বিপুল ঋণকে নিয়মিত দেখানোর সুযোগ তৈরি করা হয়েছিল। ওই আইনে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি সম্পর্কিত ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ২০২৩ সালের ২১ জুন সংসদে পাস হয়। কিন্তু বাস্তবে আইনটি ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা আনার বদলে প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের সুরক্ষা দিয়েছে এবং খেলাপি ঋণের আসল চিত্র আড়াল করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আইন অধ্যাদেশ জারি করে বাতিল করা গেলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে ব্যাংক খাতে নতুন শৃঙ্খলা ফিরতে পারে।

আওয়ামী সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের গোপন চিত্র একে একে প্রকাশ পাচ্ছে। কার্পেটের নিচে চাপা পড়া খেলাপি ঋণ এখন প্রকাশ্যে আসছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক মিলিয়ে ডজনখানেক প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ আর্থিক অনিয়ম উন্মোচিত হয়েছে। ২০২৫ সালের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ছয় লাখ কোটি টাকা। দেশের মোট ঋণ প্রায় ২০ লাখ কোটি টাকা হলে তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই খেলাপি। অর্থনীতিবিদদের মতে, এ অবস্থায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে ‘রুগ্ণ’ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

জানা যায়, এই বিপুল খেলাপি ঋণের বোঝা মোকাবেলায় সরকার এখন বাজেট থেকে করদাতাদের অর্থ ব্যবহার করে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলো মার্জ করার উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ যেসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অনিয়ম, অর্থপাচার এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো ব্যাংক খাতকে আজকের অবস্থায় নিয়ে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে এখনো কার্যকর বিচার বা জবাবদিহি হয়নি। এই পরিস্থিতি শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, নৈতিকভাবেও গভীর হতাশাজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, জনগণের টাকায় ব্যাংক রক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও প্রকৃত দায়ীদের আইনের আওতায় না আনা হলে খাতের আস্থাহীনতা আরো গভীর হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সব গ্রাহককে সমানভাবে দেখতে চাই। কোনো গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংকের ভালো সম্পর্ক থাকলে সে অপরাধ করেও ছাড় পেয়ে যেতে পারে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি হলেও ব্যাংক তাকে বিশেষ ছাড় দিতে পারে। আবার নিরপরাধ গ্রাহকের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ থাকার কারণে তিনি ইচ্ছাকৃত খেলাপিতে পরিণত হতে পারেন। তাই আমরা সব খেলাপিকে এক পাত্রে রাখতে চাচ্ছি। ঋণখেলাপিদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে না পারলে ভালো গ্রাহক নিরুৎসাহ হবেন। আমরা চাই, ব্যাংক খাতের ওপর আবার জনগণের পূর্ণ আস্থা ফিরে আসুক।’