Image description

বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫২টি। এর মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পতন হওয়া আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে। জুলাই সনদ ইস্যুতে ঐকমত্য কমিশনের কয়েক ধাপের সংলাপে অন্তত ৩৩টি দল ও সমমনা জোট অংশ নেয়। এর মধ্যে মাত্র ২১টি রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। ফলে জুলাই সনদের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের যোগাযোগ, সংলাপ বা মতামত গ্রহণের বাইরেই রয়ে গেছে নিবন্ধিত অন্তত ৩০টি রাজনৈতিক দল।

বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মৌলিক সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যোগে বেশিরভাগ নিবন্ধিত দলের অনুপস্থিতি ভবিষ্যতের ঐক্যের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। কমিশন সংলাপে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মতামত নিয়ে ‘জুলাই সনদ’ চূড়ান্ত করার পথে এগোলেও বাইরে থাকা দলগুলোর ভূমিকা ও অবস্থান বিবেচনায় রাখা জরুরি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।

রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কাঠামোর নানামুখী সংস্কারের সুপারিশ সংবলিত বহুল আলোচিত এ জুলাই সনদ প্রস্তুত হয়েছে। আগামী শুক্রবার জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে এই সনদে স্বাক্ষর করবেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশগ্রহণ করা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। এরই মধ্যে দলগুলোর কাছে এ সনদের কপিও পাঠানো হয়েছে। তবে সংস্কারের এই প্রক্রিয়া থেকে বাইরেই রয়ে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। এসব দলের সঙ্গে কোনো ধরনের সংযোগ স্থাপন বা মতামত নেয়নি ঐকমত্য কমিশন। ফলে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ হিসেবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় বিপুলসংখ্যক দলের অংশগ্রহণ না থাকায় ভবিষ্যতে এই ঐকমত্যের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কমিশনের উচিত ছিল আলোচনার দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা। যেসব দল সংলাপে আমন্ত্রণ পায়নি বা অংশ নেয়নি তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ানো না গেলে চূড়ান্ত সনদের গ্রহণযোগ্যতা একটি সীমিত পরিসরে আটকে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া সংস্কারের লক্ষ্য অর্জন নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন থেকে যেতে পারে।

এদিকে ঐকমত্য কমিশন মনে করছে, যেসব দল পতিত সরকারের সহযোগী ও জোটে ছিল, তাদের এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়নি। অন্য বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত রয়েছে। ফলে এ বিষয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন ওঠার সুযোগ নেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের রাজনৈতিক সংকটের স্থায়ী সমাধানে জাতীয় ঐক্য গড়ার লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশের সব অংশীজনের মতামত নিয়ে একটি জাতীয় সনদ বা ভিত্তি তৈরি করার লক্ষ্যেই এ কমিশন গঠন করা হয়। যার মাধ্যমে ভবিষ্যতের রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নির্ধারিত হবে। কিন্তু শুরু থেকেই কমিশনের সংলাপে অংশগ্রহণকারী দলের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। কমিশন কর্তৃক সংলাপে আমন্ত্রিত দলগুলোর যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দেখা যায় অনেক নিবন্ধিত ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, নিবন্ধন নেই এমন অনেক দলকেই রাখা হয়েছে এই সংস্কার প্রক্রিয়ায়।

ঐকমত্য কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, আমজনতার দল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, গণঅধিকার পার্টি, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, জাকের পার্টি, জাতীয় গণফ্রন্ট, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টি-বিএসপি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-মার্কসবাদী, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি ও ১২ দলীয় জোট জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ও জুলাই সনদ প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র ২১টি দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত।

অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত বাকি ৩০টি দলকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়নি। ফলে নিবন্ধিত হয়েও কোন যুক্তিতে এবং কোন মানদণ্ডের ভিত্তিতে এসব রাজনৈতিক দলকে সংলাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, সেই প্রশ্ন তুলেছেন দলগুলোর নেতারা। তাদের মতে, ঐকমত্য কমিশনের মূল লক্ষ্য হলো ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ তৈরি করা। এই সনদটি হবে ভবিষ্যতের রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি। যদি এই সনদের তৈরির প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ ও অসম্পূর্ণ হয়, তবে চূড়ান্ত সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও জনমনে সন্দেহ থাকবে। সনদের পূর্ণাঙ্গ গ্রহণযোগ্যতার জন্য প্রয়োজন সব নিবন্ধিত দলের সম্মতি এবং অংশগ্রহণ।

বামপন্থি দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মতো দলগুলোও অভিযোগ করেছে যে, কমিশন এখন পর্যন্ত জনগণের সামনে আলোচনার জন্য জরুরি বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে আনছে না। তারা মনে করে, নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত করা, টাকার খেলা বন্ধ করা, এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণা মুক্ত করার মতো জরুরি আলোচনায় এখনো পুরোপুরি প্রবেশ করা যায়নি।

কয়েকটি দলের নেতারা অভিযোগ করেছেন যে, কমিশন একটি বিশেষ দলগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে আলোচনাটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এ ধরনের অভিযোগ কমিশনের ওপর সাধারণ জনগণের এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আস্থায় চির ধরায়।

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত জাতীয় পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী কালবেলাকে বলেন, যে কোনো সনদ তৈরির ক্ষেত্রে যত বেশি অংশীজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, ততই জাতির জন্য মঙ্গল, সনদের গ্রহণযোগ্যতা ও টেকসইয়ের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু জুলাই সনদে তো বড় বড় দলকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে সেসব বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এ সনদ গ্রহণ করবে না। ফলে রাষ্ট্রীয় বিভাজন প্রকট আকার ধারণ করবে। সনদ হওয়া উচিত ছিল ঐক্যের প্রতীক, তা না হয়ে জুলাই সনদ জাতীয় অনৈক্যের প্রতীক হয়ে গেল।

বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মুহাম্মদ আলী ফারুকী বলেন, এ সনদকে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের কথা বলা হলেও, তা হয়নি। অর্ধেক দলকে তো কমিশনের ডাকাই হয়নি। এমন দলকেও ডাকা হয় যাদের নিবন্ধন-ই নেই, অথচ নিবন্ধিত অর্ধেক দল এ আলোচনার বাইরেই ছিল। তাই বাইরে যতটুকু জানা যায় তাই দেখছি, দর্শক সারি থেকে কিছু বলতেও পারা যাচ্ছে না।

জাতীয় পার্টি-জেপির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, জুলাই সনদ বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতি। এর আগেও এ ধরনের প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক দলগুলো করেছিল এরশাদ সরকারের পতনের পর। এর সফলতা নির্ভর করবে কতটা বাস্তবায়িত হয় তার ওপর। যেহেতু সনদ তৈরির বৈঠকে ডাকা হয়নি, সনদে কী আছে জানি না, সুতরাং এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো জানি না। এক কথায় যারা এ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে তারা দেখুক, আমরা তো নেই।

ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ঐকমত্য কমিশন ও জুলাই সনদ ইস্যুতে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টির (বিএমজেপি) সভাপতি সুকৃতি কুমার মণ্ডল কালবেলাকে বলেন, চলতি বছরের ৯ এপ্রিল রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা নিবন্ধন পেয়েছি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে সংলাপে অনিবন্ধিত দলকে ডাকা হলেও আমাদের ডাকা হয়নি। প্রধান উপদেষ্টা ও ঐকমত্য কমিশনে আমরা দরখাস্ত দিয়েছি। সংবাদ সম্মেলন করেও দাবি জানানো হয়েছে। তবুও আমাদের মতামত নেওয়া হয়নি।

তিনি বলেন, যদি সবার অধিকার সমান থাকে তবে ১২ থেকে ১৩টি নিবন্ধিত দলকে ডাকা হলেও আমাদের কেন ডাকা হবে না। পাঁচ-সাত মাস ধরে ঘটা করে সবার মতামত নেওয়া হয়েছে। আমাদেরও কিছু বিষয় ছিল, আমরাও তো এ দেশের নাগরিক। দুঃখজনক হলো, জুলাই সনদ একপেশেভাবে স্বাক্ষর করা হচ্ছে। যেহেতু আমাদের জানানো হয়নি, আমরা তো জোর করে মতামত দিতে পারব না।

বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) অতিরিক্ত মহাসচিব আসলাম হোসাইন বলেন, আমাদের অবস্থান সবসময় জুলাই আন্দোলনের পক্ষে ছিল। জুলাই আন্দোলনে যারা ছিলেন ও আন্দোলন পরবর্তী সরকার ব্যাপারটাকে কোন চোখে দেখছে, আমরা সেটা জানি না। তবে বৈষম্যেবিরোধী আন্দোলনের যে মূল চাওয়া ছিল, এখানেও আমরা বৈষম্য দেখতে পাচ্ছি। আমাদের মতামত ছাড়াই জুলাই সনদ স্বাক্ষর হচ্ছে। এটি জাতির জন্য দুঃখজনক।

বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এ কে এম আনোয়ারুল ইসলাম চান বলেন, ঐকমত্য কমিশনে আমাদের ডাকা হয়নি। আমরাও যোগাযোগ করিনি। জুলাইয়ের যে চাওয়া, তা জুলাই সনদে বাস্তবায়িত হবে, এটা সবার প্রত্যাশা। আর জুলাই সনদ যদি সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে আন্দোলনের যে স্পিরিট—তা টিকে থাকবে না। আশা করি জুলাই সনদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অটুট থাকবে এবং রাজনীতি স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।

তৃণমূল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মেজর (অব.) ডা. শেখ হাবিবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, আমরা জুলাই সনদের স্বপক্ষে। ঐকমত্য কমিশন থেকে আমাদের মতামত চাওয়া হয়নি। তবে জুলাই সনদ নিয়ে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) চেয়ারম্যান শাহ্ মোহাম্মদ আবু জাফর কালবেলাকে বলেন, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে কিছুটা অবসর নিয়ে চুপচাপ আছি। চেয়ারম্যান হিসেবে থাকলেও দলটিতে এখন সক্রিয় নেই।

ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশের মহাসচিব মো. রেহান আফজাল (রাহবার) বলেন, ঐকমত্য কমিশনে আমাদের মতামত নেওয়া হয়নি। দলের চেয়ারম্যান ইমাম আবু হায়াত দেশ ও জনগণের কল্যাণে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে কথা বলার কারণে বিরাগভাজন হয়েছেন। জুলাই সনদের বিষয়ে আমাদের দলের সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল। তবে শুধু সনদ দিয়ে তো আর রাষ্ট্র চলে না। যদি মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকত, অবশ্যই আমরা কথা বলতাম।

বাংলাদেশ মুসলিম লীগের (বিএমএল) সভাপতি অ্যাডভোকেট শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী বলেন, আমাদের মতামত নেওয়া ওনারা প্রয়োজন মনে করেনি। কেন সেটা জানি না।

বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের (মুক্তিজোট) প্রধান আবু লায়েস মুন্না কালবেলাকে বলেন, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হলেও আমাদের সংগঠনের মতামত নেওয়া হয়নি। এটি দুঃখজনক।

বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির মহাসচিব জাফর আহমেদ জয় কালবেলাকে বলেন, ঐকমত্য কমিশনে আমাদের ডাকা হয়নি। এমনকি মতামতও নেওয়া হয়নি। বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে কিন্তু সরকার ও ঐকমত্য কমিশনই বৈষম্য করছে। নিবন্ধিত অনেক রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়া হয়নি।

ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের মহাসচিব আবুল বাশার মুহাম্মদ জয়নুল আবেদীন জুবাইর বলেন, আমরা ঐকমত্য কমিশনের কোনো চিঠি পাইনি। জুলাই সনদকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখি। তবে এ নিয়ে মতামত দেওয়ার কোনো সুযোগ আমরা পাইনি।

বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান মাওলানা এমএ মতিন কালবেলাকে বলেন, ঐকমত্য কমিশনের কোনো সংলাপে আমাদের দাওয়াত দেওয়া হয়নি। আমরা জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় অংশীদার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান সরকারে যারা আছেন তারা জাতিকে আবার বিভক্ত করার জন্য একটা অংশকে নিয়ে ফের তারা যে কাণ্ডগুলো করছেন আমরা তার প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানাই। এতগুলো নিবন্ধন রাজনৈতিক দলকে মতামত দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। সংস্কারের নামে যেগুলো করছে এবং মতামত নিচ্ছে; এ ব্যাপারে তারা একমত হচ্ছেন, আবার দ্বিমত হচ্ছেন। এ নিয়ে যারা মতামত দিচ্ছেন ও নিচ্ছেন এর দায়ভার তারাই নেবেন।

বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীরপ্রতীক কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির নীতিবাক্য হলো পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি। জুলাইয়ে তরুণ সম্প্রদায়ের আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে পরিবর্তন এসেছে, সেই পরিবর্তনকে স্বাগত জানাই। ঐক্যমত্য কমিশনের সংলাপ ও জুলাই সনদ স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টিকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও কেন দাওয়াত দেওয়া হয়নি সেটি সুস্পষ্টভাবে জানি না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া। যখন দেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার বাইরে রাখা হয়, তখন সেই আলোচনা থেকে প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত বা ঐকমত্য দেশের পূর্ণাঙ্গ প্রতিনিধিত্ব করে না। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাদের প্রতিটি দলেরই দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রস্তাবনা রয়েছে। অতীতের সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুতরাং সবার মতামত গ্রহণ না করলে সেই ‘ঐকমত্য’ শুধু একটি আংশিক বা খণ্ডিত ঐকমত্য হিসেবে বিবেচিত হবে, যা ভবিষ্যতে ফের নতুন করে রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিতে পারে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ শাহজাহান সাজু কালবেলাকে বলেন, জুলাই সনদ কোনো আইন নয়, এটি একটি সমঝোতা। এ সমঝোতায় ঐকমত্য কমিশন কাকে রাখবে বা রাখবে না সেটা নির্ভর করছে কমিশনের ওপর। আর যারা এই সনদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অথবা সনদে স্বাক্ষর করছেন তারাই এটি মানতে বাধ্য। বাকিরা তো করেননি, সেজন্য তারা বাধ্যও নন। তবে যারা করেননি, তারা ভবিষ্যতে এর বিরুদ্ধে যে রাস্তায় নামবেন না, তার গ্যারান্টি নেই। ফলে এটি ভবিষ্যতে সমস্যা হতেও পারে। তিনি আরও বলেন, যেসব দলকে ডাকা হয়নি বর্তমান হয়তো তাদের সমর্থন কম। কিন্তু ভবিষ্যতে তাদের সমর্থন বাড়বে না তেমন নয়। আর ভবিষ্যতে এসব দলের সঙ্গে অন্য দলও একজোট হলে এ সনদ বাস্তবায়নে বাধা হতে পারে।

এ মতের বিরোধিতা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে যেসব রাজনৈতিক দলের সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছিল, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় তারা থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেটাই হয়ে থাকে। পরাজিত কাউকে কোনো প্রক্রিয়ায় রাখা হয় না। ইসিতে নিবন্ধিত অনেক রাজনৈতিক দল বিগত সরকারের সহযোগী ও সমর্থক থাকায় তাদের জুলাই সনদে যুক্ত করা হয়নি। ফলে আগামীতে সরকারের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকলে জুলাই সনদেরও বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকবে।

তবে বারবার যোগাযোগ করা হলেও ঐকমত্য কমিশনের কেউ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।