Image description

চূড়ান্ত জুলাই জাতীয় সনদে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের উচ্চকক্ষে ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা আলোচিত পিআর পদ্ধতি রাখা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের ১০০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন। এ ছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোকে সাতটি অঙ্গীকার করার শর্ত রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করার অঙ্গীকার নেওয়া হবে দলগুলোর কাছ থেকে। চূড়ান্ত সনদে ৮৪ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এর মধ্যে কয়টি দল একমত, একমত নয়, মতামত দেয়নি ও নোট অব ডিসেন্ট সংযুক্ত করা হয়েছে। সনদে বিদ্যমান সংবিধানে থাকা চার মূলনীতি বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি সনদে রাখা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এ ছাড়া সংবিধান সংশোধনে গণভোটের প্রয়োজন হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গতকাল চূড়ান্ত জুলাই জাতীয় সনদের কপি পাঠানো হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করা দলগুলোর কাছে। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকালে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে দলগুলোর স্বাক্ষর করার কথা। যদিও এরই মধ্যে কয়েকটি দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে।

কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে গতকাল জানানো হয়েছে, ‘স্বাক্ষরের আগে আমরা যে চূড়ান্ত কপি পেয়েছি তা দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্বাক্ষরের সুবিধার জন্য দুই দিন আগে দলগুলোর কাছে সনদের চূড়ান্ত কপি পাঠানো হয়েছে। সব দল সনদে স্বাক্ষর করবে বলে আমরা আশাবাদী।’ এদিকে চূড়ান্ত জাতীয় সনদ দলগুলোর কাছে পাঠানো হলেও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে কোনো পদক্ষেপের কথা বলা হয়নি।

কমিশন জানিয়েছে, গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নে দলগুলো সম্মত হয়েছে। তবে বিতর্ক রয়ে গেছে জাতীয় নির্বাচনের দিন নাকি তার আগে গণভোট হবে ওই ইস্যু নিয়ে। চূড়ান্ত সনদ বাস্তবায়নের সাত অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে। যেহেতু জনগণ এ রাষ্ট্রের মালিক। তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে। তাই এ সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করা হবে। সনদের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। বরং সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।

২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণ অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে। অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, গণ অভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে গণ অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকান্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা দেওয়া এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।

জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করা হবে। শেষ অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে। চূড়ান্ত সনদে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সংসদের নিম্নকক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ এবং উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হবে। তবে প্রস্তাবসহ সুনির্দিষ্ট কতগুলো অনুচ্ছেদ যেমন ৮, ৪৮, ৫৬, ১৪২ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, যেটি ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ, ৫৮৬ অনুচ্ছেদ হিসেবে সংবিধানে যুক্ত হবে তা সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হবে। সনদে সংবিধানে থাকা রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি বাদ দিয়ে ওই অংশে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ উল্লেখ থাকবে বলা হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, আইন অনুযায়ী আইনসভার উভয় কক্ষের (নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ) সদস্যদের গোপন ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৪)-এ বর্ণিত যোগ্যতাগুলো এবং রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার সময় কোনো ব্যক্তি কোনো রাষ্ট্রীয়, সরকারি বা রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের পদে থাকতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনে সনদে বলা হয়েছে, কোনো

আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত যে কোনো দে র মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করার এবং যে কোনো দ মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকবে এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত মানদ , নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণক্রমে তিনি উক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। এ ধরনের কোনো আবেদন বিবেচনার আগে মামলার বাদী বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পরিবারের সম্মতি নেওয়া হবে। চূড়ান্ত সনদে প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ সম্পর্কে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে যত মেয়াদ বা যত বারই হোক সর্বোচ্চ ১০ বছর থাকতে পারবেন। এজন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলোর প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা ব্যক্তি একই সঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন না, এ বিধান সংবিধানে যুক্ত করা হবে।

চূড়ান্ত সনদে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলা হয়েছে। নিম্নকক্ষ (জাতীয় সংসদ) এবং উচ্চকক্ষ (সিনেট) ১০০ সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচন পদ্ধতি ও এখতিয়ার সম্পর্কে বলা হয়েছে, নিম্নকক্ষের নির্বাচনে পাওয়া ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের ১০০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন। সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ক্রমান্বয়ে ১০০ আসনে উন্নীত করা হবে। এ ছাড়া বিদ্যমান সংরক্ষিত ৫০টি আসন বহাল রেখে সংবিদানের অনুচ্ছেদ ৬৫(৩)-এ প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হবে।

সনদে জাতীয় সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিদ্যমান বিধান পরিবর্তন করে এরূপ যুক্ত করা হবে যে জাতীয় সংসদের সদস্যগণ কেবল অর্থ বিল এবং আস্থা ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজ দলের প্রতি অনুগত থাকবেন। অন্য যে কোনো বিষয়ে তাঁরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন। সনদে সংবিধানের অধীনে সুপ্রিম কোর্ট ও জেলা ইউনিটের সমন্বয়ে একটি স্থায়ী সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন করা হবে। এ ছাড়া সনদে সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ৭৭(১)-এ যুক্ত করা হবে যে এ সংবিধানের অধীনে দেশে একজন ন্যায়পাল থাকবেন। সনদে বিচার বিভাগ সংস্কারে একটি স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস গঠনের জন্য আইন প্রণয়ন এবং তা কার্যকরের কথা বলা হয়েছে। জরুরি অবস্থা জারির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের বিধান যুক্ত করা হচ্ছে। সনদের ৮৪ নম্বর ঐকমত্যে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপের পক্ষভুক্ত হতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলসমূহের করণীয় প্রসঙ্গে সনদে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলসমূহ দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে দলীয় পদ বা নির্বাচনে মনোনয়ন দেবে না।