
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের প্রোজেকশন মিটিংয়ে (পরিচিতি সভা) বিতরণের জন্য আনা প্রায় ২০০ প্যাকেট খাবার ফিরিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সোমবার (১৩ অক্টোবর) রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের খালেদা জিয়া হলে পরিচিতি সভায় শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণের জন্য এসব খাবার আনা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন হল ফটকে গিয়ে এসব ফেরত পাঠায়।
ঘটনার একটি ভিডিও পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করেছে। ছাত্রশিবিরের দাবি, আচরণবিধিতে এমন কোনো বিধিনিষেধ নেই যে, পরিচিতি সভায় খাবার বিতরণ করা যাবে না। নির্বাচন কমিশনও বিষয়টি আচরণবিধি লঙ্ঘন কি না, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেনি।
প্রত্যক্ষদর্শী ও নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, হলের প্রজেকশন সভায় খাবার বিতরণ করা আচরণবিধি লঙ্ঘন দাবি করে নির্বাচন কমিশনে গত মঙ্গলবারে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করে ছাত্রদল মনোনিত প্যানেল। সোমবার সন্ধ্যায় শিবির মনোনীত প্যানেল খালেদা জিয়া হলে প্রোজেকশন সভার আয়োজন করে। এতে তারা হলে শিক্ষার্থীদের বসার জন্য বাইরে থেকে চেয়ার ভাড়া করে নেয়।
হল প্রশাসন তাদের হলের ভেতরের চেয়ার-টেবিল দিয়েই কার্যক্রম চালাতে বলে। রাত পৌনে ৮টার দিকে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের জন্য খাবার আনে প্যানেলটি। এ সময় হল ফটকে উপস্থিত হয়ে তাদের খাবার প্রবেশে বাধা দেন নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মোস্তফা কামাল আকন্দসহ অন্যান্যরা। পরে তাদের ৫ বস্তায় আনা প্রায় ২০০ প্যাকেট খাবার ফেরত পাঠান নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা।
পরিচিতি সভায় অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে নির্বাচন কমিশনে মৌখিক অভিযোগ জানিয়েছে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীরা। তারা রাত সাড়ে ৮টা থেকে প্রায় পৌনে ১ ঘণ্টা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করেন।
নির্বাচনের আচরনবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগের বিষয়ে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের এজিএস পদপ্রার্থী এস এম সালমান সাব্বির বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনারদের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল যে, সবকিছু আচরণবিধিতে থাকবে না—কিছু বিষয় উহ্য থাকে। আমরা বারবার বলেছি, আপনাদের যে বিষয়গুলো উহ্য বা অস্পষ্ট, সেগুলো নির্দেশনা আকারে আজকে অথবা কালকে প্রকাশ করবেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সেই নির্দেশনা ও আচরণবিধিকে সামনে রেখে সেগুলো বাস্তবায়ন করব। কিন্তু এখন হঠাৎ করে এ বিষয়টা উহ্য রয়েছে, আচরণবিধি লঙ্ঘনের নামে নতুন কোনো বাহানা তৈরি করলে আমরা শিক্ষার্থীরা সেটি মেনে নেব না। আপনাদের যদি কোনো কথা থাকে, সেটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করবেন—বলে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে এসেছি।’
নির্বাচন কমিশনে আলোচনা শেষে পরিচিতি সভায় অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে শাখা ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সাল বাবু বলেন, ‘ছাত্রশিবির মনোনীত প্যানেল এখনও পর্যন্ত নির্বাচনের লিখিত আচরণবিধির একটিও ভঙ্গ করেনি। ছাত্রদল মনোনীত প্যানেলের প্রার্থীসহ বিভিন্ন প্যানেলের এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনের আচরণবিধি ভঙ্গ করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আজকে একটি হলের পরিচিতি সভায় প্রথমেই হলের অভ্যন্তরে আমাদের চেয়ার প্রবেশ করতে দেয়নি হল প্রশাসন। পরে আমাদের সংস্কৃতির অংশস্বরূপ দাওয়াত করা মেহমানদের জন্য আনা খাবার পরিবেশন করতে দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে আচরণবিধিতেও স্পষ্ট কিছু বলা নেই। এভাবে একটি নির্দিষ্ট দলের প্রতি পক্ষপাতমূলক ও অপেশাদার আচরণ করতে থাকে, তাহলে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়।’
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামাল আকন্দ বলেন, ‘আসলে তারা খুবই পোলাইটলি রেসপন্স করেছে এবং আমরা তাদের ধন্যবাদ দিতে চাই, তারা সাথে সাথেই এটি সরিয়ে নিয়েছে। আসলে আমরা তো তাদেরই নির্বাচনটা করে দিতে এসেছি এবং আমরা খুবই আশাবাদী। শিক্ষার্থীদের এরপর থেকে এমন ছোটখাট বিষয়ে যেন আমাদের মুখোমুখি করতে না হয়, তারা নিজেরাই দায়িত্বটা নেবে।’
ছাত্রশিবির সমর্থত ‘সম্মিলিত ছাত্র জোট’র খাবার ফেরত পাঠানোর বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সব হল পরিদর্শনে বেরিয়েছি। খালেদা জিয়া হল থেকে বের হওয়ার সময় গেটে দেখি কিছু খাবারের প্যাকেট নিয়ে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, এখানে সম্মিলিত ছাত্র জোটের একটি পরিচিতি সভা হচ্ছে, সেই উপলক্ষে এই খাবার আনা হয়েছে। তখন আমি তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিই, এভাবে খাবার বিতরণ করা যাবে না। এরপর খাবারগুলো যেখান থেকে আনা হয়েছে, সেখানে ফেরত নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিই। আমাদের নির্দেশের পর খাবারগুলো ফেরত পাঠানো হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাকসু নির্বাচনে প্যানেলভুক্ত প্রার্থী থেকে শুরু করে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও ছোটখাটো আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। তবে এসব বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো লিখিত অভিযোগ না আসায় সেগুলোকে তেমন বড় করে দেখিনি। যেসব অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে পাওয়া গেছে, সেগুলো যাচাইয়ে আমাদের কমিটি চিঠি দিয়েছে এবং প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হয়েছে। পাশাপাশি আমরা সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে স্পষ্ট করে জানাতে চাই, এখন থেকে কোনো প্রার্থী নির্বাচনি প্রচারণায় খাবার পরিবেশন করতে পারবেন না।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘দেখুন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা হয়তো পরিচিতি সভা করে এভাবে খাবার দেওয়ার সামর্থ্য রাখে না। কিন্তু জোটবদ্ধ প্রার্থীরা সেটা পারছে। এতে প্রার্থীদের মধ্যে একটি বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। আমরা চাই, সবার জন্য সমান সুযোগ থাকুক এবং নির্বাচন আচরণবিধির মধ্যে থেকে সবাই প্রচারণা চালাক।’