
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিচার-কর্ম বিভাগের সংস্কারে অনেকগুলো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বাধীন এবং দক্ষ ও দুর্ভোগমুক্ত বিচার বিভাগ গড়ে তুলতে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এবার বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই সংস্কার কার্যক্রমকে পূর্ণতা দিতে যাচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অধ্যাদেশ জারির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে আইন মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ-২০২৫-এর একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় এই খসড়া অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উত্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদের আন্তঃমন্ত্রণালয় সংক্রান্ত বাছাই কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ থেকে আগামী বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই খসড়া অধ্যাদেশ উত্থাপন করা হবে। বৈঠকে আলোচনাসাপেক্ষে খসড়া অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করা হবে।
বিচার-কর্ম বিভাগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা নাগরিক সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায় থেকে দীর্ঘদিনের দাবি। এই সচিবালয় প্রতিষ্ঠার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। পাশাপাশি বিচার বিভাগ পৃথককরণ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায়েও বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় করার কথা বলা হয়েছে। ওই রায়ের আলোকে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার পরও বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব থেকে যায়। পরে রাজনৈতিক সরকারের আমলে বিচার বিভাগ পৃথককরণের কাজ আর এগোয়নি।
গত বছর ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিচার বিভাগের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব নেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। দায়িত্ব নেওয়ার অল্পদিনের মাথায় গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি তার অভিভাষণে বিচার বিভাগের সংস্কারের লক্ষ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। সেখানেও তিনি বিচার বিভাগের দ্বৈত শাসনের অবসানে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় জোর দেন। অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, ‘বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না; যতদিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা, অর্থাৎ, সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটি হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ।’
পৃথক সচিবালয়ের প্রস্তাব প্রেরণ
বিচার বিভাগের সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী বর্তমান প্রধান বিচারপতির নির্দেশে গত বছরের ২৭ অক্টোবর পৃথক সচিবালয় করার প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রস্তাবনায় বলা হয়, সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগের পৃথককরণ নিশ্চিতকরণকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, আমাদের সংবিধানে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক রাখার কথা বলা হলেও সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এদেশে বিচার বিভাগের কার্যকর পৃথককরণ অসম্পূর্ণই থেকে গেছে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, এমন একটি প্রেক্ষাপট সত্ত্বেও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ৭৯/১৯৯৯ নম্বর সিভিল আপিল মামলার রায়ে (যা মাসদার হোসেন মামলা নামেই অধিক সমাদৃত) নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগের পৃথককরণের পূর্ণ রূপরেখা তুলে ধরার মাধ্যমে আমাদের দেশে ক্ষমতার পৃথককরণ নীতির বাস্তবায়নের পথকে সুগম করে দিয়েছে। ওই রায়ে ক্ষমতার পৃথককরণের যে রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে, তার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হলো দেশের বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা।
প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়, বিগত বছরগুলোয় রাজনৈতিক সরকারের অনীহার কারণে বিচার বিভাগের পৃথককরণ সম্ভব হয়নি। এ কারণে বিগত জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বর্তমান সময় হচ্ছে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের শ্রেষ্ঠ সময়।
এতে বলা হয়, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি হাইকোর্ট বিভাগকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগের এই তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ নয়। কেননা বিদ্যমান কাঠামোতে আইন মন্ত্রণালয় হতে অধস্তন আদালত সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাব আসার পর হাইকোর্ট বিভাগ তার তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু আমাদের সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের মর্ম অনুসারে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ হাইকোর্ট বিভাগের একচ্ছত্র অধিকার। তাই সাংবিধানিক এই বাধ্যবাধকতা সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক।
পৃথক সচিবালয় নিয়ে সংস্কার কমিশনের মতামত:
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গঠিত বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কার্যত সংবিধানের ২২, ৯৪(৪), ১০৯ এবং ১১৬ক অনুচ্ছেদের বিধান এবং মাসদার হোসেন মামলার রায়ের নির্দেশনা সত্ত্বেও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, ছুটি, শৃঙ্খলা ইত্যাদি নির্বাহী বিভাগের আওতায় থেকে গেছে। একইভাবে অধস্তন আদালতের বিচারকদের ওপর সুপ্রিম কোর্ট এবং আইন মন্ত্রণালয়—এ দুটি কর্তৃপক্ষের যুগপৎ নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিচারকদের বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি, ছুটি, শৃঙ্খলা ইত্যাদি বিষয় নির্বাহী বিভাগের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে থাকায় বিচার বিভাগ নিম্নবর্ণিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে:
প্রথমত, মন্ত্রণালয়ের প্রধান হলেন মন্ত্রী, যিনি মূলত একজন রাজনীতিবিদ। কাজেই আইন ও বিচার বিভাগের একজন মন্ত্রী হিসেবে তিনি যখন বিচারকদের বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি, ছুটি, শৃঙ্খলা ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন অনেক ক্ষেত্রে সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে যায়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যথাযথ দায়িত্ব পালন করার কারণে বহু বিচারককে মন্ত্রী তথা নির্বাহী বিভাগের রোষানলে পড়তে হয়েছে কিংবা নিপীড়নমূলক বদলির সম্মুখীন হতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে ৪টি বিধিমালা প্রণয়ন এবং ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের মাধ্যমে বিচার বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেসি অংশ পৃথক করা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের কারণে বিদ্যমান দ্বৈত শাসনের অংশ হিসেবে বিচার কর্ম বিভাগের সব বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় তথা সরকারের ওপর নির্ভরশীল। এটি স্পষ্ট যে, ২০০৭ সালে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আনুষ্ঠানিকভাবে আংশিক পৃথক হলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিচার বিভাগ এখনো পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হতে পারেনি। এ কারণে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথককরণ পূর্ণাঙ্গ, কার্যকর ও ফলপ্রসূ করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা অত্যাবশ্যক।
সর্বশেষ অগ্রগতি:
প্রধান বিচারপতির উদ্যোগ এবং সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পর বিচার বিভাগে অনেক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও কিছু অগ্রগতি হয়েছে। বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানসংবলিত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গত ২ সেপ্টেম্বর এক গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন। রায়ে সংবিধানের বিদ্যমান ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল করে বাহাত্তরের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়েছেন। এ রায়ের ফলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান, ছুটি মঞ্জুরিসহ) শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের হাতে ফিরে এসেছে। প্রায় ৫০ বছর আগে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের নিয়ন্ত্রণের যে একক ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতছাড়া হয়েছিল, এ রায়ের মাধ্যমে সেটা সর্বোচ্চ আদালতের হাতে ফিরে এসেছে। এ রায়ের বাস্তবায়ন হলে বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ বদলি ও শৃঙ্খলা বিধানের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপ্রিম কোর্টকে আর ধরনা দিতে হবে না। বিলোপ হবে বিচার বিভাগের দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা। এ ছাড়া রায়ে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের পাঠানো প্রস্তাবনা অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে তিন মাসের মধ্যে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিচারকদের জন্য ২০১৭ সালে তৈরি করা শৃঙ্খলাবিধি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হয়েছে।
খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি:
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ-২০২৫-এর খসড়া তৈরি করা হয়েছে। খসড়ায় এ সচিবালয় প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা হিসেবে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ, সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ এবং মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে। খসড়ার ৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় কোনো মন্ত্রণালয় বা দপ্তরের অধীন থাকবে না। এটি একজন সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত হবে। অধ্যাদেশের ৫(১) ধারায় সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কার্যাবলি নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান, বিচারকদের নিয়োগ ও শৃঙ্খলা, বাজেট ব্যবস্থাপনা, প্রশাসন ও গবেষণা। অধ্যাদেশের ৬(১) ধারায় সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রধান বিচারপতির হাতে থাকবে এবং সচিব প্রশাসনিক প্রধান হবেন। ৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, বিচার প্রশাসনকে অধিক কার্যকর করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়ে এক বা একাধিক কমিটি গঠন করা হবে। এ অধ্যাদেশের আওতায় সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের জন্য নির্ধারিত বাজেট ব্যয় অনুমোদনের চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির হাতে থাকবে। ১১ নম্বর ধারায় কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, ১৩ নম্বর ধারায় বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, ১৫ নম্বর ধারায় সচিবের প্রশাসনিক দায়িত্ব এবং ১৬ নম্বর ধারায় সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় ও অধস্তন আদালতের সাংগঠনিক কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় এ খসড়াটি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উত্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন:
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক সরকারের কাছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আশা করা কঠিন। তাই এ সরকারের আমলেই বিচার বিভাগের আমূল সংস্কার প্রয়োজন। এরই মধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কারে প্রধান বিচারপতির ঘোষিত রোডম্যাপ ও সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিচার বিভাগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের লক্ষ্যে উপযুক্ত ব্যক্তি বাছাই করে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ-২০২৫’ শিরোনামে একটি অধ্যাদেশ গেজেট প্রকাশ। বিচার বিভাগের পদ সৃজনের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কমিটির হাতে ন্যস্ত করে বিধিমালা জারি। জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা-২০২৫ নামে জারি করা এই বিধিমালায় জুডিসিয়াল সার্ভিসের বিচারিক ও প্রশাসনিক পদগুলোকে ‘ক্যাডার’ পদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি সার্ভিসের পদগুলোকে রাজস্ব খাতে স্থায়ীভাবে সৃজনেরও বিধান করা হয়েছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রায় সাতশ নতুন বিচারিক পদ সৃজন করা হয়েছে। গত ৭ অক্টোবর জেলা জজ ও অধস্তন আদালতগুলো এবং বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতগুলো (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৯ এবং জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসির আদালতগুলো (সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ২০০৮-এর সংশোধন করে অধস্তন আদালতে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের হাতে নেওয়া হয়েছে। বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবে দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। লিগ্যাল এইড আইনের সংশোধন করে ৯টি মামলা বাধ্যতামূলকভাবে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির বিধান চালু করা হয়েছে। বিচার বিভাগ থেকে সব ধরনের দুর্নীতি বিলোপের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীর জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক বিচারসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিতকল্পে প্রধান বিচারপতির ১২ দফা নির্দেশনা ঘোষণা করেছেন। এ ছাড়া পেপার ফ্রি বেঞ্চ চালু, অধস্তন আদালতের বিচারকদের সংখ্যা বৃদ্ধি, বদলি ও পদায়ন নীতিমালা তৈরি, দেশব্যাপী সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা, সারা দেশের আদালতে হেল্প লাইন চালু, সুপ্রিম কোর্ট হেল্প লাইন চালু, বিচারিক কূটনীতি ও বিচার ব্যবস্থার আন্তর্জাতিকীকরণে প্রধান বিচারপতির নানামুখী পদক্ষেপ, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন পুনর্গঠন, বিচারকদের সুদমুক্ত গাড়ি নগদায়ন সুবিধা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ, আদালত প্রাঙ্গণসহ বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংস্কার এবং অধস্তন আদালতের মামলার দৈনন্দিন কার্যতালিকা বাধ্যতামূলকভাবে অনলাইনভিত্তিক করাসহ অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘বিচার বিভাগের জন্য বাজেট বরাদ্দ এবং বিচারকদের বদলি, পদায়ন ও শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষমতা এককভাবে সুপ্রিমকোর্টের হাতে থাকবে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা। বিচারকদের বদলি-পদায়ন নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপমুক্ত হবে—এ দাবি দীর্ঘদিনের। আশা করি সরকার আমাদের দাবি মেনে পদক্ষেপ নেবে।’
জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব এবং অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. শাহজাহান সাজু বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিচার বিভাগের সংস্কারে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় হলে এসব সংস্কার পূর্ণতা পাবে। আশা করি পৃথক সচিবালয় গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগ পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপমুক্ত হবে।
বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের সদস্য ও আইন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ পরামর্শক ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন কালবেলাকে বলেন, পৃথক সচিবালয় অধ্যাদেশ পাস হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কার্যকরভাবে পূর্ণতা পাবে। উচ্চ ও অধস্তন আদালতের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ কার্যকরভাবে সুপ্রিমকোর্টের হাতে ন্যস্ত হবে। সংস্কার কমিশনের মূল যে সুপারিশ, সেটার বাস্তবায়ন হবে। তবে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনসহ সংস্কার কমিশনের আরও কিছু সুপারিশ এখনো বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে।