
গণ-অভ্যুত্থানের ৩৬ দিনের শেষ দিন। ৫ আগস্ট দুপুর বেলা। গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে কলেজছাত্র হৃদয় হোসেনকে ঘিরে ধরেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। চড়থাপ্পড়, কিলঘুসি মারছেন। কেউ কেউ আবার কলার ধরে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছেন। একটু দূর থেকেই দৌড়ে এলেন পুলিশের এক কনস্টেবল। কাছে এসেই অন্য পুলিশের মাঝ দিয়ে ঢুকে হৃদয়ের পিঠে রাইফেল ঠেকিয়ে ট্রিগার চেপে দিলেন। গুলির বিকট শব্দ। কয়েক সেকেন্ডেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন হৃদয়। ছটফট করে হাত-পা নাড়তে থাকেন। তাকে দাঁড়াতেও দেওয়া হয়নি। তার নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মাটিতে পড়ে থাকা হৃদয়ের দেহ থেকে স্রোতের বেগে রক্ত বের হতে থাকে। অল্প সময়ে রাস্তা লাল রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। পুলিশ হৃদয়ের নিথর দেহ পা দিয়ে ঠেলে দেখেন মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে কি না। পরে ৪ জন পুলিশ সদস্য মিলে হৃদয়ের গুলিবিদ্ধ মরদেহ হাত-পা ধরে টেনে-হিঁচড়ে দূরে নিয়ে যান। নিহত হৃদয়ের লাশ তার স্বজনদের ফেরত না দিয়ে সেখান থেকে তা তুলে নিয়ে তুরাগ নদীর কড্ডা ব্রিজের নিচে ভাসিয়ে দেয় পুলিশ।
সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম কলেজছাত্র হৃদয় হত্যার এমন মর্মস্পর্শী বর্ণনা দেন। এ সময় তিনি হৃদয়কে হত্যার ভিডিও প্রদর্শন করেন। ট্রাইব্যুনালের বড় স্ক্রিনে যখন ভিডিওটি প্রদর্শিত হচ্ছিল, তখন সবার চোখ টলমল করছিল। এজলাসে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। চিফ প্রসিকিউটর জানান, গুলি করা ওই কনস্টেবলের নাম আকরাম হোসেন (২২)। ঘটনার সময় তিনি গাজীপুর শিল্প এলকায় কর্মরত ছিলেন। গ্রেফতারের পর আকরাম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হৃদয় হত্যার কথা স্বীকার করেছেন।
এদিকে শুনানির সময় প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনার আরও একটি অডিও ক্লিপ শোনানো হয়। ফোনালাপটির শুরুতে স্যার সম্বোধন করে সালাম দেন একজন। তারপর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘ওরা কিন্তু জায়গায় জায়গায় এখন জমায়েত হতে শুরু করেছে। মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এবং বিভিন্ন জায়গায়। শুরুতেই কিন্তু ইয়ে...করতে হবে, একদম শুরুতেই। ধাওয়া দিলে এরা গলিতে গলিতে থাকবে। এবার আর কোনো কথা নাই। এবার শুরুতেই দিবা।’ চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে দ্বিতীয় দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ মামলায় ৫৪ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ এবং জেরার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। গত বছরের জুলাই আন্দোলন চলাকালীন ৪১টি জেলার ৪৩৮টি স্থানে হত্যকাণ্ড এবং ৫০টিরও বেশি জেলায় মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। এদিন জুলাই আন্দোলনে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনের শিরোনাম পড়ে শোনান তিনি। এছাড়া শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষী প্রয়াত রাষ্ট্রচিন্তক বদরুদ্দীন ওমর ও আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের জবানবন্দি পড়ে শোনান চিফ প্রসিকিউটর।
শুরুতে জুলাই-আগস্ট আন্দোলন নিয়ে নির্মিত একটি দৈনিক পত্রিকার প্রামাণ্যচিত্র তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর। এর ভিডিওতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে সরকারপ্রধান হিসাবে শেখ হাসিনার ভূমিকাসহ আওয়ামী লীগের দুর্গ ভেঙে পড়ার বিবরণ দেওয়া হয়। ওই ভিডিওতে ল এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির এক কর্মকর্তার সঙ্গে শেখ হাসিনার একটি ফোনালাপের কথা বলা হয়। পরে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে শোনানো হয় সেই অডিও রেকর্ড। এ প্রসঙ্গে চিফ প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালকে বলেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে কথোপকথনের অপরপ্রান্তের ব্যক্তি হলেন কর্নেল রাজিব। গত বছরের ২৯ জুলাই ফোনের মাধ্যমে কর্নেল রাজিবকে এ নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তার শেষ কথা হচ্ছে, ‘এবার আর কোনো কথা নাই। এবার শুরুতেই দিবা।’ মানে আসামাত্রই গুলি করা হবে। এটাই ছিল নির্দেশনা। কর্নেল রাজিব তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি মিলিটারি সেক্রেটারি ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশে নেই।
কলেজছাত্র হৃদয় হত্যা মামলা : হৃদয়কে হত্যার ঘটনায় কোনাবাড়ী থানায় একটি মামলা হলেও সেখানে কোনো পুলিশ সদস্যের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়নি। তবে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। হৃদয় হত্যার পর লাশ গুমের বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে একটি প্রতিবেদন প্রচার করা হয়। তখন নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় মামলার তদন্ত। এরই ধারাবাহিকতায় মামলাটি তদন্ত শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও একটি মামলা হয়। গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর খুনি পুলিশের কনস্টেবল আকরাম হোসেনকে তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের পারাইল এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তদন্ত সূত্রে জানা যায়, হত্যার পর হৃদয়ের লাশ পুলিশি তত্ত্বাবধানে গুম করা হয়। গ্রেফতার হওয়া পুলিশ সদস্যরা সেই লাশ গুমের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে বর্ণনা দিয়েছেন। তারা জানান, ঘটনাস্থল থেকে একটি ভাড়া করা গাড়িতে করে লাশটি নিয়ে তুরাগ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। লাশটি ফেলার পর পুলিশ সদস্যরাও সেখান থেকে পালিয়ে যান। নিহত কলেজছাত্র হৃদয় (২০) টাঙ্গাইলের গোপালপুরের আলমনগর গ্রামের লাল মিয়ার ছেলে। তিনি হেমনগর ডিগ্রি কলেজে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। গরিব ঘরের সন্তান। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি কোনাবাড়ী এলাকায় অটোরিকশা চালাতেন। এ মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম শুনানি করেন। তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এসএইচ তামিম, বিএম সুলতান মাহমুদ ও আব্দুস সাত্তার পালোয়ান। পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আর এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ। আবদুল্লাহ আল-মামুনকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। বিকালে যুক্তিতর্ক মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতুবি করেন ট্রাইব্যুনাল।