
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শেষ হলেও, গণভোটের সময়সূচি নিয়ে পূর্বের অবস্থান থেকে সরেনি দলগুলো। জামায়াত ও এনসিপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজনের পক্ষে অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে। অন্যদিকে বিএনপি সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটের পক্ষে তাদের আগের অবস্থান তুলে ধরেছে।
বিজ্ঞাপন
ঐকমত্য কমিশনের সূত্রে জানা যায়, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে তৃতীয় ধাপের পঞ্চম দিন তথা শেষ দিনের সংলাপ গত বুধবার (৮ অক্টোবর) শেষ হয়। সেখানে গণভোটের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে দলগুলো একমত হলেও, সময় নির্ধারণে মতপার্থক্য রয়ে যায়। বিএনপিসহ তাদের যুগপৎ আন্দোলনের অধিকাংশ শরিক জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দেয়। অন্যদিকে জামায়াত, এনসিপি এবং আরও কয়েকটি দল নির্বাচনের আগেই গণভোট চায়। বিষয়টির সমাধানে কমিশন বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে আলাদা বৈঠক করে, তবে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি।
বৈঠকে মূলত জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায়, গণভোটের সময় এবং ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। কমিশন দলগুলোর অবস্থান কাছাকাছি আনার চেষ্টা করলেও, তিনটি দলই তাদের আগের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। ফলে এখন পর্যন্ত মতপার্থক্য দূর করার প্রয়াস সফল হয়নি।
গত শনিবার (১১ অক্টোবর) জাতীয় সংসদ ভবনে কমিশনের কার্যালয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয়। বিকেলে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিনের সঙ্গেও পৃথক বৈঠক করে কমিশন।
দুই দলের প্রতিনিধিরা নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের পক্ষে নিজেদের যুক্তি উপস্থাপন করেন। এনসিপি নেতারা জানান, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে সংকট নিরসন না হলে সংস্কার প্রক্রিয়া অর্থহীন হবে।
জামায়াতের প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে কমিশনকে জানানো হয়, নির্বাচনের দিন গণভোট হলে দুই ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে— প্রথমত, দলীয় প্রতীকের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মানুষ গণভোটে আগ্রহ হারাতে পারে; দ্বিতীয়ত, সহিংসতা বা সংঘাতের কারণে অনেক ভোটকেন্দ্রে ভোট স্থগিত হলে গণভোটও প্রভাবিত হবে। তাদের মতে, জুলাই সনদের মর্যাদা রক্ষায় নির্বাচনের আগে গণভোট হওয়াই যুক্তিসঙ্গত।
জামায়াত নেতা হামিদুর রহমান আযাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আলোচনা তো গত বুধবারই শেষ হয়েছে। গণভোট নিয়ে আমাদের অবস্থান অপরিবর্তিত আছে। নতুন কোনো ভাবনা আমাদের নেই।
সূত্রে জানা গেছে, এনসিপিও নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছে। তবে দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, জুলাই সনদের আপত্তির (নোট অব ডিসেন্ট) বিষয়টি তুলে দিলে গণভোটের সময়সূচি নিয়ে তারা ছাড় দিতে রাজি। তাদের মতে, পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে সমাধান ছাড়া সংস্কার কার্যক্রম অর্থহীন।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, জুলাই সনদের বিষয়ে গণভোটে একটি প্রশ্নের মাধ্যমেই মীমাংসা হতে হবে। সেখানে আপত্তির বিষয় রাখা যাবে না। জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট হলে জুলাই সনদ গুরুত্ব হারাবে। তাই জনগণকে সংস্কার কার্যক্রমে যুক্ত করার জন্য নির্বাচনের আগেই গণভোট জরুরি।
অন্যদিকে রোববার (১২ অক্টোবর) জাতীয় সংসদ ভবনে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনই সবচেয়ে যৌক্তিক। ওইদিন ভোটের হার বেশি থাকবে, মানুষের আগ্রহও থাকবে এবং খরচ কম হবে। নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করলে ভোটের উপস্থিতি কমার পাশাপাশি সহিংসতার আশঙ্কা ও ব্যয় বাড়বে।
তবে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য জানতে ফোনে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি।
ঐকমত্য কমিশনের এক সদস্য জানান, গণভোটের সময়সূচি নির্ধারণ করবে সরকার ও নির্বাচন কমিশন। কমিশনের সুপারিশ পাওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিষয়টি উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। গত শনিবার (১১ অক্টোবর) কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে চূড়ান্ত জুলাই সনদ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
প্রধান উপদেষ্টা কমিশনকে বলেছেন, সুবিধাজনক সময়ে সনদ পাঠাতে, তবে পাঠানোর আগে তাকে জানাতে হবে।
ঐকমত্য কমিশনের সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টা রোম সফর শেষে দেশে ফিরে আগামী বুধবার বা বৃহস্পতিবার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করবেন। কমিশনের মেয়াদ ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হবে। এছাড়া, জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আগামী ১৭ অক্টোবর বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদের এলডি হলে জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। জনগণের অংশগ্রহণের সুবিধার্থে এটি ১৭ অক্টোবর (শুক্রবার) বিকেলে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হবে।
যদিও এর আগে কমিশনের তরফে জানানো হয়েছিল, অনুষ্ঠানটি ১৫ অক্টোবর (বুধবার) বিকেলে আয়োজন করা হবে।