Image description

বাংলাদেশে এখনও বেসরকারি টেলিভিশন লাইসেন্সের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়াই চলছে বেসরকারি টিভি চ্যানেল। যেকোনও নাগরিকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য মন্ত্রণালয় বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের অনুমোদন দেয়। ২০১৪ সালে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় সম্প্রচার কমিশন গঠনের কথা বলা হলেও পরে সেটি আর গঠিত হয়নি। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশও অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়ন করেনি। স্বাভাবিক নিয়মেই সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন—বেসরকারি টেলিভিশন সম্প্রচার নীতিমালা কবে হবে?

জানা গেছে, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকার কারণে লাইসেন্স নেওয়ার পরও অনেক টিভি চ্যানেল এখনও সম্প্রচারে আসেনি। সম্প্রচারের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে বারবার কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলেও কবে নাগাদ সম্প্রচারে আসবে তার দিনক্ষণ নির্ধারণ করতে পারছে না। অনেকে লাইসেন্সের মালিকানার অংশ বিক্রি করে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, বেসরকারি টিভি চ্যানেল অনুমোদন দেওয়ার জন্য আলাদা কোনও আইন নেই। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা আছে। যেখানে বলা আছে, সব সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানকে সরকার বা সরকার থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। এক্ষেত্রে টিভির লাইসেন্সের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভির অনুমোদন দেয়।

বাংলাদেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বর্তমানে ৫০টি। এর মধ্যে সম্প্রচারে রয়েছে ৩৬টি। বাকি ১৪টি সম্প্রচারের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে সম্প্রচার শুরু হওয়ার পরে বিভিন্ন কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ছয়টি চ্যানেল। এগুলো আবার চালু হচ্ছে মর্মে বিভিন্ন সূত্রে খবর বের হলেও সত্যতা মেলেনি।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের যেকোনও নাগরিক বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল অনুমোদনের জন্য আবেদন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আবেদনের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র, আর্টিক্যাল অব মেমোরেন্ডাম (প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্র), সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশন, ট্রেড লাইসেন্স, আয়কর সনদ, ব্যাংক সলভেন্সি সনদ, প্রকল্প প্রস্তাব এবং চ্যানেল চালানোর সামর্থ্য আছে মর্মে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা জমা দিতে হয়। আবেদন করার পর তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যাচাই করা হয়। বেসরকারি টিভি লাইসেন্স পাওয়ার পর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছ থেকে ‘ফ্রিকোয়েন্সি ক্লিয়ারেন্স’ নিতে হয়। মূলত সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের ‘সবুজ সংকেত’ থাকলেই ‘ফ্রিকোয়েন্সি ক্লিয়ারেন্স’ অর্থাৎ তরঙ্গ পাওয়া যায়।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে সম্প্রচারে থাকা ৩৬টি চ্যানেলের মধ্যে মিশ্র বিনোদনমূলক চ্যানেল ২৩টি। এগুলো হলো- আনন্দ টিভি, এশিয়ান টিভি, এটিএন বাংলা, বাংলা টিভি, বাংলা ভিশন, বিজয় টিভি, বৈশাখী টেলিভিশন, চ্যানেল নাইন, চ্যানেল আই, দীপ্ত টিভি, দেশটিভি, ইটিভি, গ্লোবাল টিভি, জিটিভি, মাছরাঙা, মোহনা টিভি, মাইটিভি, নাগরিক, এনটিভি, আরটিভি, এসএ টিভি, গ্রিন টিভি ও চ্যানেল এস। সংবাদ চ্যানেল ৮টি। এগুলো হচ্ছে- এটিএন নিউজ, চ্যানেল ২৪, ডিবিসি নিউজ, একাত্তর টিভি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন, যমুনা টিভি, নিউজ ২৪ ও সময় টিভি। সংগীত চ্যানেল একটি- গান বাংলা। শিশু কিশোরদের জন্য কিডস চ্যানেল একটি- দুরন্ত টিভি। খেলাধুলার চ্যানেল একটি- টি-স্পোর্টস এবং ইনফোটেইনমেন্ট চ্যানেল দুটি- এখন টিভি ও নেক্সাস টিভি।

যে ৬টি বেসরকারি চ্যানেল সম্প্রচারে আসার পরে বিভিন্ন কারণে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে সেগুলো হচ্ছে- চ্যানেল ওয়ান, চ্যানেল সিক্সটিন, সিএসবি নিউজ, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ড। তবে যে ১৪টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল এখনও সম্প্রচারে আসেনি সেগুলোর নাম তথ্য মন্ত্রণালয়ের কোনও ডেস্কেই পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট ডেস্কের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, সম্প্রচারের অপেক্ষায় থাকা চ্যানেলগুলোর পুরো ফাইল যাচাই-বাছাইয়ের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ডেস্ক কর্মকর্তার দফতরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সব চ্যানেলের কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একসঙ্গে আসে না। যখন যেটা আসে তখন সেটার কাজ শেষ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আবার কোনও কোনও চ্যানেলের কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের জন্য এনএসআই, এসবি বা ডিবিতেও পাঠানো হয়ে থাকে। কাজেই একসঙ্গে পুরো তালিকা কখনোই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেক টিভি চ্যানেলেরই লাইসেন্স পাওয়ার পর সম্প্রচারের যোগ্য করতে বিপুল পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে কেউ কেউ বিনিয়োগকারী খোঁজেন, আবার কেউ কেউ চ্যানেলের মালিকানা বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। পছন্দ অনুযায়ী বিনিয়োগকারী অথবা পছন্দের ক্রেতা না পাওয়ার কারণে কিছু চ্যানেল সম্প্রচারে আসতে বিলম্ব করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ডিসি অফিস থেকে পত্রিকার ডিক্লারেশন পাওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পত্রিকা প্রকাশের বাধ্যবাধকতা থাকলেও লাইসেন্স পাওয়ার পর কতদিনের মধ্যে চ্যানেলটিকে সম্প্রচারে আনতে হবে এমন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় চ্যানেলগুলো সম্প্রচারে আসতে দেরি করছে বলে অভিযোগ অনেকের। লাইসেন্স পাওয়ার পর চ্যানেল সম্প্রচারের উপযোগী করতে বিনিয়োগকারী ম্যানেজ করা মোটামুটি সহজ হলেও চ্যানেলের মালিকানা বিক্রি করাটা বেশ জটিল বলে জানিয়েছেন চ্যানেল সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, লাইসেন্স পাওয়ার পর চ্যানেলটি সম্প্রচারের যোগ্য করতে আর্থিক সচ্ছলতা তৈরি করা একটি বড় কাজ। এর জন্য একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করার বিধান রয়েছে। সেখানে চ্যানেলটির মালিকানা নিশ্চিত করতে একাধিক শেয়ার বণ্টন করতে হয়। চ্যানেলটির লাইসেন্স যার নামে তার নামে আগে ৫১ শতাংশ শেয়ার রাখার বিধান থাকলেও এখন তা কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। চ্যানেলটি কেউ বিক্রি করতে চাইলেই পুরোটা বিক্রি করতে পারবেন না। এটি একটি জটিলতা। এ ছাড়াও বিক্রির ক্ষেত্রে কোনও ক্রেতাই লাইসেন্সের মালিক হতে পারবেন না। এর অর্থ হচ্ছে- যার নামে লাইসেন্স তাকে অবশ্যই চ্যানেলটির ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। লাইসেন্স অন্য কারও নামে হস্তান্তর করা যাবে না। এসব কারণে সম্প্রচারে না আসা টিভি চ্যানেলগুলো আলোর মুখ দেখতে পারছে না।

উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের প্রবর্তন হয়। তখন দেশে ১০টির মতো বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার হতো। বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলা, ১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরু করে। ১৯৯৯ সালে চ্যানেল আই সম্প্রচার শুরু করে। সেই সময়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বেসরকারি খাতে টিভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ১৯৯৮ সালে। ওই বছর বেসরকারি মালিকানায় টেলিভিশন চ্যানেল স্থাপন ও পরিচালন বিষয়ক নীতি প্রকাশ করা হয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার তিনটি টিভির অনুমোদন দেয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদে ১০টি টিভি অনুমোদন পায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ১০টি চ্যানেলকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে আরও দুটি টিভি চ্যানেল লাইসেন্স পায়। ২০১১ সালের জুনে একটি, অক্টোবরে একটি এবং ওই বছরের ডিসেম্বরে আরও একটি টিভির লাইসেন্স দেওয়া হয়। ২০১৩ সালে ১৫টি চ্যানেলের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল বলে তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

জানতে চাইলে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মোহম্মদ আলতাব-উল-আলম এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে অপারগতা জানান।  

একাত্তর টিভির সাবেক কর্মকর্তা মনির হোসেন লিটন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বেসরকারি টিভি লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে এখনও কোনও নীতিমালা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। ফলে অনেকেই লাইসেন্স নিয়ে বিনিয়োগকারী খুঁজতে অনেক সময় অতিবাহিত করার ফলে চ্যানেলটির সম্প্রচারে আনতে পারে না। অনেকে আবার মালিকানা বিক্রিরও চেষ্টা করে। ফলে লাইসেন্স পাওয়া টিভি চ্যানেলকে সম্প্রচারে আনতে দেরি হয়। এক্ষেত্রে নীতিমালা না থাকাটাও দায়ী বলে মনে করি আমি।’