Image description

পুলিশের বিশেষ বাহিনী র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা সংক্ষেপে র‍্যাব। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে কয়েক বছর আগে এ বাহিনী এবং এর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এ নিষেধাজ্ঞা মাথায় নিয়েই গত বছর জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে বিশেষায়িত এ বাহিনীর বিরুদ্ধে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার শাসনামলে গুমের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় র‍্যাবের সাবেক বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এছাড়া, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে ১২ হাজার সদস্যের এ বাহিনীর কার্যক্রমে কার্যত নিষ্ক্রিয় ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন পরিস্থিতিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় র‍্যাবকে কীভাবে কাজে লাগানো হবে সে বিষয়েও প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে।

২০০৪ সালে পুলিশের একটি বিশেষায়িত ইউনিট গঠন করার প্রক্রিয়া শুরু করে তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। ওই বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের প্যারেডে কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এলিট ফোর্স র‍্যাবের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর উত্তরাঞ্চলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান এবং দক্ষিণাঞ্চলে চরমপন্থীবিরোধী অভিযান চালিয়ে আলোচনায় আসে পুলিশের এ বিশেষায়িত ফোর্স। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনামলে র‍্যাবের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের মতো ঘটনার অভিযোগ এনেছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গুমের একটি মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে। এ আসামিদের অনেকেই একসময় র‍্যাবে কর্মরত ছিলেন। এ গুমসংক্রান্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও অন্য আসামিরা হলেন শেখ হাসিনার সাবেক প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ (র‍্যাবের সাবেক মহাপরিচালক), র‍্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এম খুরশিদ হোসেন, সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার মো. হারুন-অর-রশিদ, র‍্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল কেএম আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুব আলম, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, সাবেক পরিচালক লে. কর্নেল মো. সারোয়ার বিন কাশেম, সাবেক পরিচালক লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম, সাবেক পরিচালক লে. কর্নেল মো. মশিউর রহমান জুয়েল ও সাবেক পরিচালক লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন।

এর আগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে র‍্যাব ও এ বাহিনীর ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন রাজস্ব বিভাগ ও পররাষ্ট্র দপ্তর। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছয়জনই ছিলেন র‍্যাবের সাবেক ও তৎকালীন মহাপরিচালক বা অতিরিক্ত মহাপরিচালক। এর মধ্যে ছিলেন র‍্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ এবং সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. আনোয়ার লতিফ খান। এর আগে ২০১৮ সালের মে মাসে কক্সবাজারের টেকনাফে পৌর কাউন্সিলর একরামুল হককে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে র‍্যাবের সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়।

 

জানা যায়, র‍্যাবের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন; অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক এবং এ জাতীয় অন্যান্য বস্তু উদ্ধার; অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার। পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় অন্যান্য বাহিনীকে সহায়তা, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, সরকার নির্দেশিত যেকোনো অপরাধের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা ও সরকার নির্দেশিত যেকোনো জাতীয় দায়িত্ব পালন করা। এর বাইরে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নজরদারিতে রাখা এবং তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও র‍্যাবের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, র‍্যাব পুলিশের একটি বিশেষায়িত ফোর্স হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কার্যক্রমে বিশেষায়িত অর্জন ক্ষীণ হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের শেষ কয়েক বছরে শীর্ষ সন্ত্রাসী দমন, অবৈধ অস্ত্র-মাদক উদ্ধারে তাদের ভূমিকা যথেষ্ট দৃশ্যমান হয়নি। এরপর গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে তা নিয়ন্ত্রণে র‍্যাবের নিষ্ক্রিয়তা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ঢাকাসহ সারা দেশে একের পর এক মব, হত্যা, চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটলেও তা দমনে মাঠে র‍্যাবকে কার্যকর ভূমিকায় দেখা যায়নি বলেই মনে করছেন অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে র‍্যাবকে অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে কাজে লাগাবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।

র‍্যাবকে শুধু পুলিশের বিশেষ ইউনিট হিসেবেই কার্যকর রাখা উচিত বলে মনে করেন গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যেসব সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে তাদের মধ্যে অধিকাংশই র‍্যাব ও ডিজিএফআইয়ে কাজ করেছেন। বিগত সময়ে র‍্যাব গুম-খুনের মতো অপরাধের সঙ্গে এত বেশি মাত্রায় যুক্ত হয়েছে যে তাদের ওপর আস্থা রাখার কোনো সুযোগ নেই। গত এক বছরে র‍্যাবের কিছু পরিবর্তন আমরা দেখেছি। আমাদের মনে হয়েছে সেনাবাহিনী থেকে কোনো সদস্যকে প্রেষণে না দিয়ে র‍্যাবকে পুলিশের একটি ইউনিট হিসেবেই কাজে লাগানো যায়। কারণ পুলিশ সরাসরি মানুষের সঙ্গে কাজ করে।’

র‍্যাবকে পেশাদার একটি বাহিনী হিসেবে সংস্কার করে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজে লাগানোর বড় সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে র‍্যাবকে দিয়ে অনেক ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ করা হয়েছে বা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি র‍্যাব কিছু ভালো কাজও করেছে। দেশের বিভিন্ন বিপর্যয়ের সময় তাদের যে সহযোগিতা আমরা লক্ষ করেছি সেটি প্রশংসার দাবি রাখে। সুতরাং র‍্যাবের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের ভূমিকাই রয়েছে। এখন যদি শুধু নেতিবাচক ভূমিকাকে আমলে নিয়ে বা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের গ্রেফতারি পরোয়ানার ভিত্তিতে (র‍্যাবের কয়েকজন সাবেক কর্মকর্তার) রাষ্ট্র চায় র‍্যাবকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে, তাহলে সেটা করা যেতেই পারে। কিন্তু র‍্যাবের সক্ষমতা বিবেচনায় এবং বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদের যদি একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে অবশ্যই ভালো ফল পাওয়ার সুযোগ আছে।’

ড. তৌহিদুল হক আরো বলেন, ‘তবে এটাও সত্যি যে যারা র‍্যাবে থেকে ব্যক্তিস্বার্থে নানা অপরাধে যুক্ত হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। আমরা র‍্যাবের বিরুদ্ধে যেসব বিতর্ক বা আইনবহির্ভূত কাজে যুক্ত হওয়ার অভিযোগ দেখেছি সেখান থেকে র‍্যাবকে বের করে এনে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে তাদের কাজে লাগানোর অবকাশ রয়েছে।’

র‍্যাব ও বাহিনীর সাবেক কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, কয়েকজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গুমের মামলা এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা র‍্যাবের নিয়মিত কার্যক্রমে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে কিনা এবং সামগ্রিকভাবে তাদের কার্যক্রমে কোনো নিষ্ক্রিয়ভাব তৈরি হয়েছে কিনা জানতে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এমজেডএম ইন্তেখাব চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।