
রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন (৩৪)। ২০২২ সালের ৩ জানুয়ারি তার ব্লাড ক্যানসার (অ্যাকিউট প্রমাইলোসাইটিক লিউকেমিয়া) ধরা পড়ে। প্রথমে চিকিৎসা শুরু হয় মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে।
সেখানে ইনডাকশন কেমোথেরাপির প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়। কিন্তু পরবর্তী ধাপে তিনি ভারতে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন। সেখানে চার দফায় ৮০টি কেমোথেরাপি নিতে হয় তাকে। প্রতি ২৮ দিন চিকিৎসা ও পরের ২৮ দিন বিশ্রামের মাধ্যমে প্রায় ১০ মাসের চিকিৎসায় তার খরচ হয় প্রায় ২৪ লাখ টাকা।
বিদেশে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে শাহাদাত আমার দেশকে বলেন, দেশে চিকিৎসা প্রোটোকল থাকলেও চরম অব্যবস্থাপনা, আসন সংকট ও ঘুসের সংস্কৃতি পরিস্থিতিকে অসহনীয় করে তুলেছে। চিকিৎসকরা ভিন্ন ভিন্ন ওষুধ কোম্পানির হয়ে কাজ করায় ওষুধ নির্বাচনে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। রোগীর অবস্থা জানাতে তারা গোপনীয়তা বজায় রাখেন না। এমনকি অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন লাগবে কি না জানতে চাইলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়।
শাহাদাত আরো বলেন, নার্সদের অবহেলায় ক্যানুলা ইনফেকশন হয়ে হাতে পুঁজ জমে অস্ত্রোপচার করতে হয়। দ্বিতীয় ধাপের কনসোলিডেশন কেমো নিতে গেলেও ভর্তি ফর্ম পাননি, ঘুস ছাড়া আসন পাওয়া যায়নি। অবশেষে অনিয়ম ও অনিশ্চয়তায় ক্লান্ত হয়ে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
সিরাজগঞ্জের অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষিকা ঢাকাতেই ক্যানসারের চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার ছেলে আব্দুল্লাহ আল সাফি বলেন, ক্যানসার শনাক্ত হওয়ার পর রোগীকে মানসিকভাবে সামলানোর মতো প্রশিক্ষিত চিকিৎসক খুব কম। প্রাথমিক পর্যায়ের ডাক্তারদেরও রোগীকে সান্ত্বনা ও সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার প্রশিক্ষণ থাকা দরকার। আমাদের বড় সমস্যা রোগ নির্ণয় পর্যায়ে—আইডেন্টিফিকেশন, ডায়াগনোসিস ও একিউরেসিতে। বায়োপসি রিপোর্টে ভুল হলে চিকিৎসা এগোয় না, আর রোগী মাসের পর মাস অনিশ্চয়তায় ভোগে।
এ তো গেল সাধারণ দুজন ক্যানসার রোগীর কথা। গত ১৫ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যান। এ নিয়ে নেটিজেনরা শুরু করেন হৈচৈ।
প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে কি ক্যানসার চিকিৎসা এখনও অপ্রতুল? গত দেড় দশকে এই চিকিৎসা কতদূর এগিয়েছে? এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এলো এই খাতের নাজুক চিত্র।
এ বিষয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের জিএম (কমিউনিকেশন অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট) ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী খান আমার দেশকে বলেন, বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানের ঘাটতি, আধুনিক ইকুইপমেন্টের অভাব, প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসায় দেরি এবং রোগ সংক্রান্ত পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব।
পরিসংখ্যান কী বলছে
বাংলাদেশে ক্যানসার এখন একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হন এবং ১ লাখের বেশি মৃত্যুবরণ করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো ক্যানসার। বিশ্বজুড়ে চিকিৎসায় অগ্রগতি হলেও, বাংলাদেশে এখনো অবকাঠামো, জনবল ও সমন্বয়ের ঘাটতি বড় চ্যালেঞ্জ।
মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইসিআরএইচ) দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার হাসপাতাল, যা ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এখন ৫০০ শয্যার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তবে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেখানে রেডিওথেরাপি সেবা ৪৪ দিন বন্ধ থাকায় প্রায় ১০ হাজার রোগী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ সরকারি হাসপাতালগুলো ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান—যেমন ইউনাইটেড, স্কয়ার, ল্যাবএইড, এভারকেয়ার ও আহসানিয়া মিশন—ক্যানসার চিকিৎসায় ভূমিকা রাখছে। তবে সমন্বিতভাবে সার্বিক চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা খুব অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে। ফলে অধিকাংশ রোগীকে বিভিন্ন ধাপের চিকিৎসার জন্য এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরতে হয়। এ প্রক্রিয়া রোগীর ওপর আর্থিক ও মানসিক চাপ তৈরি করে।
চিকিৎসা পদ্ধতি ও প্রযুক্তি
বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসায় মূলত তিনটি পদ্ধতি বেশি ব্যবহৃত হয়—কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও সর্বাধুনিক পিইটি-সিটি ইমেজিং। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কেমো ও রেডিওথেরাপি সাধারণত পাওয়া গেলেও, টার্গেটেড থেরাপি ও ইমিউনোথেরাপি এখনো কেবল কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সীমিতভাবে চালু আছে।
রেডিওথেরাপি হলো উচ্চ-শক্তির বিকিরণ ব্যবহার করে ক্যানসার কোষ ধ্বংসের চিকিৎসা, যা টিউমার ছোট করা, অস্ত্রোপচারের আগে বা পরে কোষ ধ্বংস করা এবং ব্যথা কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এ পদ্ধতি দুভাবে প্রয়োগ হয়—এক্সটার্নাল রেডিয়েশন (শরীরের বাইরে থেকে বিকিরণ প্রেরণ) ও ইন্টারনাল রেডিয়েশন (রেডিওঅ্যাক্টিভ পদার্থ ক্যানসার স্থানে স্থাপন)। এটি সার্জারি বা কেমোথেরাপির সঙ্গে মিলিয়ে ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
কেমোথেরাপি হচ্ছে ওষুধনির্ভর চিকিৎসা, যা ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি রোধ করে বা ধ্বংস করে। এই ওষুধ রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে পুরো শরীরে কাজ করে এবং দ্রুত বিভাজনশীল কোষগুলোকে লক্ষ্য করে। এটি সার্জারির আগে বা পরে টিউমার ছোট করা, ছড়িয়ে পড়া কোষ ধ্বংস বা উপসর্গ কমাতে ব্যবহার হয়। কেমোথেরাপি দুভাবে দেওয়া হয়—সিস্টেমিক (রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে পুরো শরীরে) এবং রিজিওনাল (নির্দিষ্ট অঙ্গে সীমিত প্রয়োগ)।
ক্যানসার চিকিৎসায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে পিইটি-সিটি প্রযুক্তি। এটি ক্যানসার শনাক্তকরণ, চিকিৎসা পরিকল্পনা ও পুনরাবৃত্তি পর্যবেক্ষণে নতুন দিগন্ত খুলেছে। পিইটি স্ক্যান ক্যানসার কোষের কার্যক্রম শনাক্ত করতে রেডিওঅ্যাক্টিভ ট্রেসার ব্যবহার করে, যা শক্তিনির্ভর কোষে জমা হয়ে শরীরের সক্রিয় ক্যানসার অংশ চিহ্নিত করে। তবে বাংলাদেশে পিইটি-সিটি স্ক্যানারের সংখ্যা, দক্ষ বিশেষজ্ঞ ও আর্থিক সক্ষমতার ঘাটতি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি-বেসরকারি সমন্বয় ছাড়া রোগীর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ কতটুকু পিছিয়ে আছে
বাংলাদেশে পিইটি-সিটি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ শুরু হলেও বিশ্বের তুলনায় এখনো অনেক পিছিয়ে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ পর্যন্ত ভারতে ৫০৬ নিউক্লিয়ার মেডিসিন কেন্দ্রের মধ্যে ৪৩৭টি পিইটি-সিটি স্ক্যানার এবং প্রায় ১ হাজার ৪২৫ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছে। থাইল্যান্ডে ২০২২ সালে ১৬টি, অস্ট্রেলিয়ায় ৯২টি ও যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজার ৬০০-এর বেশি স্ক্যানার ছিল।
দেশে বর্তমানে ১২টি পিইটি-সিটি কেন্দ্র আছে—৭টি সরকারি ও ৫টি বেসরকারি। জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি হওয়ায় প্রতি ১.৫৫ কোটি মানুষের জন্য একটিমাত্র স্ক্যানার রয়েছে। ২০২৩ সালে এই কেন্দ্রগুলোতে মোট ৭ হাজার ৬৪৩টি স্ক্যান সম্পন্ন হয়েছে। অথচ বছরে নতুন ক্যানসার রোগীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৬৭ হাজার এবং পাঁচ বছরে সক্রিয় রোগীর সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৪৫ হাজার। প্রতি রোগীর জন্য কমপক্ষে তিনবার স্ক্যান প্রয়োজন।
পিইটি-সিটি স্ক্যানে ব্যবহৃত রেডিও আইসোটোপ উৎপাদনের জন্য দেশে দুটি সাইকোট্রোন মেশিন আছে—একটি ২০১০ সালে ইউনাইটেড হাসপাতালে এবং দ্বিতীয়টি ২০২০ সালে এনআইএনএমএএসে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা সীমিত—প্রায় ৩০০ জন রেডিয়েশন অনকোলজি, ৫০ জন মেডিকেল অনকোলজি, সর্বোচ্চ ১০০ জন গাইনি ও সার্জিক্যাল অনকোলজি এবং ২০০ জন নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।
অন্যান্য সমস্যা
বাংলাদেশের ওষুধশিল্প বিশ্বমানের ক্যানসার ওষুধ উৎপাদন করে, যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ করা হয়। উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইনসেপ্টা, বিকন ও জিসকা রয়েছে। দেশের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা সীমিত হলেও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও এনআইসিআরএইচে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাদাররা দায়িত্ব পালন করছেন।
ক্যানসার সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রও সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফ্রেন্ডশিপ ফাউন্ডেশন এইচপিভি পরীক্ষা ও সেলফ-টেস্টিং কিটের মাধ্যমে সেবার প্রসার ঘটাচ্ছে, আর বাংলাদেশ ক্যানসার কনসোর্টিয়াম বিভিন্ন গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
তবে উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতির উচ্চ খরচ সাধারণ মানুষের জন্য বহনযোগ্য নয়। সরকার কিছু ভর্তুকি দিলেও তা যথেষ্ট নয় এবং কিছু বেসরকারি হাসপাতাল কম খরচে সেবা দেয়, তবে সুযোগ ও মান সীমিত। আর্থিক ও মানসিক চাপের কারণে অনেক রোগী বিদেশে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন। ক্যানসার সংক্রান্ত সামাজিক স্টিগমা রোগীর মানসিক অবস্থাকে আরো জটিল করে তোলে। দেশে এখনো জাতীয় ক্যানসার রেজিস্ট্রি নেই, যা রোগীর তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। তবে সরকার ২০২৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১০ বছর বয়সি মেয়েদের জন্য এইচপিভি টিকা কর্মসূচি শুরু করেছে।
সম্ভাবনার কথা বললেন বিশেষজ্ঞরা
২০২৪ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত ‘অফিসিয়াল জার্নাল অব সোসাইটি অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন, বাংলাদেশ’-এর এক নিবন্ধে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. ফাতিমা বেগম ‘গ্রোথ অফ পিইটি-সিটি ইমেজিং অ্যান্ড ইটস পার্সপেক্টিভ’ শিরোনামে উল্লেখ করেন, আগামী দশকে ৫০ থেকে ১০০ স্ক্যানার স্থাপন সম্ভব, যা দেশের ক্যানসার চিকিৎসায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে।
ফজলে রাব্বী খান বলেন, এখন আমরা ক্যানসার চিকিৎসার জন্য যে প্রটোকোল বা গাইডলাইন অনুসরণ করি, যে কোনো উন্নত দেশ সেই একই প্রটোকল বা গাইডলাইন অনুসরণ করে। প্রযুক্তির বিস্তার, নতুন কেন্দ্র স্থাপন এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বৃদ্ধির মাধ্যমে আগামী দশকে দেশের ক্যানসার চিকিৎসাকে আন্তর্জাতিক মানে নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।