
সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, খুন, ছিনতাই, আত্মহত্যা। রাজধানীতে যে ঘটনাতেই কারোর মৃত্যু হোক না কেন- তার বেশির ভাগ লাশই নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। পরিচয় পাওয়া লাশগুলো স্বজনদের কাছে
হস্তান্তর করা হলেও নাম-পরিচয়হীন লাশগুলোর ঠাঁই হয় হিমঘরে। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাখার পর আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে সিটি করপোরেশনের জায়গায় বেওয়ারিশ লাশগুলো দাফন করে শাহবাগ থানা পুলিশ। সম্প্রতি দুই সিটির দ্বন্দ্বে লাশ দাফনের অনুমতি পাচ্ছে না আঞ্জুমান। এতে ধারণক্ষমতার চেয়েও বেশি মরদেহ নিয়ে বিপাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ। আর এর সমাধান না পেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
সরজমিন বেশ কয়েকদিন ঢামেকের মর্গ ঘুরে জানা গেছে, লাশ উদ্ধার, খুন বা ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রায় প্রতিদিনই পুলিশ এক বা একাধিক নাম-পরিচয়হীন লাশ ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসে। জরুরি বিভাগ থেকে মৃত ঘোষণা করার পর এসব লাশ প্রথমে নেয়া হয় ঢামেকের জরুরি বিভাগের মর্গে। সেখান থেকে আবার তিনদিনের জন্য রাখা হয় ঢামেকের মূল মর্গে। পরিচয় শনাক্তে এসব লাশের ছবি, ফিঙ্গারপ্রিন্টসহ ডিএনএ প্রোফাইল শেষে দাফন হওয়ার কথা। কিন্তু গত ১৭ই আগস্টের পর থেকে ঢামেকের হিমঘর থেকে তেমন কোনো বেওয়ারিশ লাশই বের হয়নি। ৪০টি লাশ রাখার ধারণক্ষমতাসমপন্ন মর্গে এক এক করে জমা হয়েছে ৪৫টি বেওয়ারিশ লাশ। বেওয়ারিশ লাশ দাফনকারী সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামও লাশ দাফন করছে না। ঢামেক মর্গের লাশ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ডোম রামু দাস বলেন, জায়গার অভাবে অতিরিক্ত লাশ সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো ফ্রিজে একটির জায়গায় ঠাসাঠাসি করে দু’টি রাখা হয়েছে। এতে লাশ পচে যাচ্ছে এবং শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, দুই সিটি করপোরেশনের গড়িমসির কারণেই এই লাশ দাফন হচ্ছে না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক কাজী গোলাম মুখলেসুর রহমান বলেন, সাধারণত বিভিন্ন কারণে নিহত হওয়া ব্যক্তির লাশ আমাদের মর্গে আনা হয়। লাশের সম্পূর্ণ দায়িত্ব থাকে পুলিশেরই। আমরা শুধু ময়নাতদন্ত ও পরিচয় শনাক্তের জন্য ডিএনএ প্রোফাইল তৈরির স্বার্থে ৩ দিনের জন্য লাশগুলো হিমঘরে রাখি। পরে আঞ্জুমানের মাধ্যমে শাহবাগ থানা পুলিশ লাশগুলো বেওয়ারিশভাবে দাফন করে। কিন্তু হঠাৎ করে কী সংকট তৈরি হয়েছে যে, রাজধানীর হাসপাতালগুলো থেকে লাশ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে তারা। বর্তমানে কোনো বেওয়ারিশ লাশ দাফন করছে না আঞ্জুমান। দুই সিটির মধ্যে নাকি ঝামেলা চলছে। কিন্তু মর্গের জায়গা সংকট হওয়ায় আমরা বারবার শাহবাগ থানায় তাগাদা দিচ্ছি লাশগুলো নিয়ে যেতে। কারণ আগের লাশ না সরালে নতুন লাশ প্রবেশ করানো সম্ভব নয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখতে পারছি না। তাই এই বিষয়ে সংশ্লিষ্টদেরকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
তবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বলছে, ৩ জনের মধ্যে ১ জনের লাশ দাফনের অনুমতি দিলেও কবরস্থানের কাজ চলমান থাকায় গত দুই বছরের মধ্যে কোনো লাশ দাফন করা যায়নি দক্ষিণ সিটি এলাকার কবরস্থানে। গত জুলাই আন্দোলনের সময় জুরাইন কবরস্থানে লাশ দাফন শুরু হলেও মাসে নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি লাশ সেখানে দাফন করতে দেয় না দক্ষিণ সিটি। তাই বাকি লাশগুলো দাফন করা হতো উত্তর সিটি করপোরেশনের কবরস্থানে। তবে গত ১৭ই আগস্ট থেকে উত্তর সিটি এলাকার বাইরের কোনো লাশ দাফনের অনুমতি দিচ্ছে না তারা। তাদের ভাষ্য- উত্তর সিটি এলাকার বাইরের একটি লাশও উত্তরের কবরস্থানে দাফন করা হবে না।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দাফন সেবা কর্মকর্তা মো. কামরুল আহমেদ বলেন, আঞ্জুমানের প্রধান কাজই হচ্ছে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা। ১০২ বছর ধরে আমরা বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে আসছি। এখানে আসলে আমাদের কোনো বা আমাদের প্রতিষ্ঠানের কোনো সমস্যা নেই। মূলত সমস্য দেখা দিয়েছে দুই সিটি করপোরেশনের কর্তা ব্যক্তিদের মধ্যে। দক্ষিণ সিটি বলছে- তাদের কবরস্থানে জায়গা নেই, মাসে মাত্র ২০টি লাশ দাফন করার অনুমতি দেবেন তারা। অপরদিকে উত্তর সিটি বলছে- তারা তাদের এলাকা ব্যতীত কারোর লাশ দাফনের অনুমতি দিবে না তাদের কবরস্থানে। আমরা প্রশাসনের অনুরোধে বেওয়ারিশ লাশ দাফনের অনুমতি নিতে দুই সিটিতেই অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছি। কিন্তু তারা দুই পক্ষই অনড়। তাই বাধ্য হয়ে আমরা লাশ দাফন করতে পারছি না।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, লাশ দাফন করা একটা মানবিক বিষয়। কিন্তু অনেক সময় আঞ্জুমান মুফিদুল সিটি করপোরেশনকে না জানিয়ে লাশ দাফন করতে সরাসরি কবরস্থানে নিয়ে চলে যায়। এ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। সেই থেকেই এই সংকট। তিনি বলেন, আমাদের দক্ষিণে কোনো সমস্যা নেই। জুরাইন, খিলগাঁও ও আজিমপুর এই তিনটি কবরস্থান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। যেগুলো বেশ পুরনো এবং এর প্রতিটিতেই জায়গার সংকট রয়েছে। অপরদিকে উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকাতে যেসব কবরস্থান আছে সেগুলোতে জায়গার পরিমাণ বেশি। সে প্রেক্ষিতে দুই সিটি করপোরেশন মিলে একটা সিদ্ধান্ত হয়, সম্প্রতি যে বেওয়ারিশ লাশগুলো মর্গে পড়ে আছে তার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ লাশ দক্ষিণ সিটি এলাকায় দাফন করা হবে। সেই হিসাবেই সম্প্রতি ১২টি বেওয়ারিশ লাশ আমরা দাফন করেছি। আশা করি দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এই জটিলতা তৈরি করছে। তারা একটি বেওয়ারিশ লাশও দাফন করছে না। তারা শুধু তাদের এলাকায় উদ্ধার হওয়া লাশের ৩ ভাগের এক ভাগ দাফন করে। অন্য কোনো দায়িত্ব নিতে চায় না। ঢামেকে সারা দেশ থেকে লাশ আসে। দাফনের জন্য আমাদেরও জায়গার সংকট রয়েছে। এজন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় উদ্ধার হওয়া লাশের বাইরে অন্য লাশ আমরা দাফন করবো না।
ঢামেক মর্গের বেওয়ারিশ লাশ দায়িত্বে থাকা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি’র শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খালিদ মনসুর বলেন, সম্প্রতি দুই সিটির দ্বন্দ্বে লাশ দাফনের অনুমতি দিচ্ছে না। ফলে আঞ্জুমান লাশ দাফন করতে পারছে না। আমরা এই বিষয়ে আমাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছি। সব শেষ ঢামেকের এসব বেওয়ারিশ লাশ দাফনের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি।
বিষয়টি নিয়ে ডিএমপি’র রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, মূলত বেওয়ারিশ লাশ দাফনের জন্য দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় জুরাইন ও উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় রায়েরবাজার কবরস্থান নির্ধারিত। কিন্তু দুই সিটির কর্মকর্তাদের মনোমালিন্যে আপাতত বেওয়ারিশ লাশ দাফন বন্ধ রয়েছে। এই প্রশাসনিক জটিলতায় আমরা নিজেরাও অনেক ঝামেলায় পড়েছি। আমরা বাধ্য হয়ে আদালতে এই সমস্যা সমাধানের জন্য আর্জি জানিয়েছি। আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।