Image description

সাগরে ব্যর্থতার পর এবার স্থলভাগে বহুজাতিক কোম্পানির জন্য গ্যাস উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) চূড়ান্ত করার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও নির্বাচনের আগে এ ধরনের উদ্যোগ কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে দ্বিধান্বিত বিশেষজ্ঞরা।

সূত্র বলছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দেশের স্থলভাগের কোনও গ্যাস ব্লক বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে না দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে ক্ষমতার একেবারে শেষ সময়ে এসে মার্কিন কোম্পানি শেভরনকে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের পাশের কিছু জমিতে নতুন করে অনুসন্ধান ও উত্তোলনের অনুমতি দেয়। এর বাইরে স্থলভাগের জন্য নতুন কোনও পিএসসি করা হয়নি। যদিও ভোলা ছাড়া দেশের অন্য কোথাও তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বড় কোনও সাফল্যও পাওয়া যায়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিগত সরকারের শেষ দিকে পিএসসি সংশোধন করে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র আহ্বান করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের আহ্বান করা দরপত্র বাতিল না করে বরং দরপত্র জমা দেওয়ার সময় বাড়িয়ে দেয়। এরপরও কোনও বহুজাতিক কোম্পানি বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ দেখায়নি।

পেট্রোবাংলার সূত্র বলছে, দেশে গ্যাসের ঘাটতির কারণে নতুন করে কূপ খনন করতে চায় সরকার। এ জন্য পেট্রোবাংলার ওপর সরকারের চাপ রয়েছে। এই কারণে স্থলভাগের জন্য একটি পিএসসি করা হয়েছে। স্থলভাগের সমতল এবং পাহাড়ি এলাকা—দুই জায়গাতেই দরপত্র আহ্বান করে বিদেশি কোম্পানিকে কাজ দিতে চায় পেট্রোবাংলা।

পেট্রোবাংলার দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, নতুন যে পিএসসি তারা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে, সেখানে গ্যাসের দাম অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের (ব্রেন্ট ক্রুড) সঙ্গে সমন্বয় করে দেওয়া হয়েছে। এই নিয়মে ব্রেন্ট ক্রুডের দামের ৮.৫ শতাংশ গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। ধরা যাক, কখনও ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি যদি ১০০ ডলার হয়, তবে এক হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম হবে ৮.৫ ডলার। বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) অন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রি হয়েছে ৬৬.১০ ডলারে। সে হিসাবে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম হবে ৫.৬১ ডলার। এর আগে স্থলভাগের পিএসসিতে নির্দিষ্ট দামে গ্যাস কেনা হতো। এখন শেভরনসহ অন্য বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে পেট্রোবাংলা আড়াই থেকে তিন ডলারের মধ্যে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস কিনে থাকে। এই হিসাবের সঙ্গে তুলনা করলে নতুন পিএসসি কার্যকর হলে স্থলভাগের গ্যাসের দামও বাড়বে।

পিএসসি অনুযায়ী পেট্রোবাংলা এবং দরপত্রে বিজয়ী কোম্পানির মধ্যে একটি চুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানি বিনিয়োগ করে। গ্যাস পাওয়া গেলে বিনিয়োগের অর্থ ধাপে ধাপে তুলে নেয় কোম্পানিটি। এরপর বাকি গ্যাস সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী পেট্রোবাংলা এবং উত্তোলনকারী কোম্পানির মধ্যে ভাগ করা হয়। পেট্রোবাংলা আবার ওই কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কিনে নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহ করে।

জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) প্রকৌশলী মো. শোয়েব বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, নতুন পিএসসি অনুমোদনের জন্য তারা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। তার দাবি, সাগরের পিএসসির তুলনায় স্থলভাগের গ্যাসের দাম কম হবে। সরকারের অনুমোদন পেলে চলতি বছরের মধ্যে দরপত্র আহ্বান করা যাবে বলে আশা করছেন তিনি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘অন্তর্বর্তী সরকারের ‘অনশোর’র মতো জায়গায় দরপত্র আহ্বানের জন্য পিএসসি করাটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। এমনিতেই তারা সারের দাম ও  শিল্পের গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। এর ফলে আমাদের উৎপাদন কমে আসবে। অপরদিকে আমদানি খরচ বাড়বে। একইভাবে সাগরের মতো স্থলভাগের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান যদি আমরা বিদেশি কোম্পানির কাছে ছেড়ে দেই, তাহলে সেখানেও গ্যাসের দাম বাড়বে।’’

তিনি বলেন, ‘‘এখনই ঘাটতি পূরণের ক্ষেত্রে এলএনজি আমদানি করতে হয়। তাতে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রাও খরচ হচ্ছে। এই অবস্থায় অনশোরের গ্যাস আন্তর্জাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া ঠিক হবে না।’’ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম আরও বলেন, ‘‘স্থলভাগে কাজের জন্য বাপেক্সকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। গ্যাস উন্নয়ন তহবিল করে আমরা বাপেক্সকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এ দায় জ্বালানি বিভাগকে নিতে হবে। বাপেক্সকে প্রতিযোগিতামূলক সুযোগ দেওয়া দরকার। বিদেশি কোম্পানির পাশাপাশি বাপেক্স কাজ করতে পারে। সেক্ষেত্রে বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।’’  

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এভাবে একতরফা বাপেক্সকে বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানির হাতে দেশের তেল-গ্যাস তুলে দেওয়াটা দেশদ্রোহিতার শামিল।’’

প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশের স্থলভাগে দেশি ও বিদেশি মিলে ২২টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এর বাইরে ভোলায় দুটি ক্ষেত্র থাকলেও তারা সরাসরি জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করতে পারে না। সেখানকার গ্যাস স্থানীয়ভাবে ব্যবহার করা হয়। পেট্রোবাংলা জানায়, সবগুলো খনি মিলে দৈনিক ১৮০০ থেকে ২০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের জোগান দিচ্ছে।

দেশের সিলেট অঞ্চলের পর গ্যাসের নতুন হাব হতে পারে ভোলা-বরিশাল অঞ্চল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও ভোলার পর শরীয়তপুরে গ্যাসকূপ খনন করে ব্যর্থ হয়েছে বাপেক্স। এরপরও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা এখনও অনুসন্ধানের বাইরে রয়েছে। এর আগে সুন্দরবনে গ্যাস পাওয়ার আশা দেখিয়েছিল শেভরন বাংলাদেশ। তবে একটি কূপ খনন করার পর মার্কিন এই কোম্পানিটি মনে করছে—সেখানে উত্তোলন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না।

অপরদিকে পাহাড়ে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ইতিহাস বেশ পুরোনো হলেও সেখানে কোনও কোম্পানিই তেমন সাফল্য পায়নি। তিন পার্বত্য জেলার তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ইতিহাস বলছে, গত শতকের প্রথম দিকে ১৯১৪ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে প্রথম বার্মা ওয়েল কোম্পানি কূপ খনন করে। তবে সেখানে কোনও গ্যাস পাওয়া যায়নি। এরপর বিভিন্ন সময়ে আরও ১২টি কূপ খনন করা হয়। কিন্তু একটিতেও উত্তোলনযোগ্য গ্যাস পাওয়া যায়নি।