
সারা দেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ( ডিএনসি ) কর্মকর্তাদের হাতে থাকা ২৯২ টি ওয়াকিটকি দীর্ঘদিন ধরে নেটওয়ার্কহীন পড়ে রয়েছে । অথচ অচল এসব যন্ত্রের দেখভাল করতে অধিদপ্তর বিভিন্ন সময়ে মোট ৭২ জন অপারেটর নিয়োগ দিয়েছে । প্রায় এক দশক এ যন্ত্রগুলো ব্যবহারযোগ্য না হলেও অপারেটররা নিয়মিত বেতন - ভাতা পাচ্ছেন । কবে নাগাদ এই ওয়াকিটকি সচল হবে , তা কেউই জানে না ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন , পুলিশের টাওয়ারে রিপিটার ও অ্যানটেনা বসাতে না দেওয়ায় ওয়াকিটকিগুলো কার্যত বোবা যন্ত্রে পরিণত হয়েছে । ২০১৬ সাল থেকে চিঠি চালাচালি ও একাধিক বৈঠক হলেও সমস্যার সমাধান হয়নি । ফলে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা অভিযান কিংবা নজরদারির সময় নিরাপদ যোগাযোগ - ব্যবস্থা ছাড়াই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন , যা নিরাপত্তা ও সমন্বয়ে বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করছে ।
অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায় , প্রায় প্রতিটি সমন্বয় সভায় কর্মকর্তারা ওয়াকিটকির অচলাবস্থার বিষয়টি তোলেন ।কিন্তু বাস্তবে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই । দীর্ঘদিনেও এ সংকটের সমাধান না হওয়ায় মাদকবিরোধী অভিযানে অনেক ক্ষেত্রে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে । অন্যদিকে, ৭২ জন অপারেটরকে মূল দায়িত্বের বাইরে নানা কাজে লাগানো হচ্ছে । জেলা কার্যালয়ে যুক্ত অপারেটরেরা করণিকের কাজ করছেন । কেউ কেউ আদালতে মাদকের প্রসিকিউটরদের সহযোগিতা করছেন । কাউকে আবার মাঠপর্যায়ে মাদকবিরোধী অভিযানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ।
সার্বিক বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ( ডিজি ) মো . হাসান মারুফ গত শনিবার আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরই ওয়াকিটকি সচল করার উদ্যোগ নিয়েছি । ঢাকায় কার্যক্রম চালুর পাশাপাশি সারা দেশে নেটওয়ার্ক চালু করতে একটি ছোট কমিটি গঠন করেছি । খুব দ্রুতই এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে ।'
অধিদপ্তরের ভেতরের অনেক কর্মকর্তা বলছেন , মূলত পুলিশ টেলিকমের সহযোগিতা না থাকায় সমস্যা জট পাকিয়ে রয়েছে । মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায় , ওয়াকিটকির জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের ( বিটিআরসি ) থেকে ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ পায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর । এরপর অধিদপ্তর রংপুর , বরিশাল , ময়মনসিংহ , পাবনা , দিনাজপুরসহ কয়েকটি জেলায় পুলিশের টাওয়ারে ডিএইচএফ রিপিটার বসানোর অনুমতি চায় । পুলিশ শর্ত সাপেক্ষে অনুমতিও দেয় । কিন্তু সেই অনুমতির প্রায় এক দশক পরও জেলা পুলিশের টাওয়ারের রিপিটার বসানোর জন্য মাদক অধিদপ্তরকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করে না পুলিশের টেলিকম বিভাগ ।
ঠিক কোন কারণে এমন অসহযোগিতা, তা অধিদপ্তর জানে না বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা । মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উত্তরাঞ্চলের এক জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ( ডিডি ) বলেন , “পুলিশ অনেক সংস্থার রিপিটার বসাতে দিয়েছে । কিন্তু মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের ক্ষেত্রে দেয়নি । কয়েকটি জেলায় টাওয়ারের একদম নিচে বসানোর অনুমতি পাওয়া গেলেও সেখানে ফ্রিকোয়েন্সি না মেলায় কোনো কাজ হয় না । ' টাওয়ার ও ফ্রিকোয়েন্সি সমস্যার বিষয়টি স্বীকার করেছেন মাদক অধিদপ্তরের ডিজি হাসান মারুফও ।
তিনি বলেন , টাওয়ার ও ফ্রিকোয়েন্সির সমস্যা এখনো আছে । আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি , যেন দেশব্যাপী ওয়াকিটকি সচল করা যায় । ' অন্যদিকে পুরো বিষয়টি পুলিশের পক্ষ থেকে দাপ্তরিক জটিলতা বলেই ব্যাখ্যা করা হচ্ছে । পুলিশ টেলিকমের অতিরিক্ত আইজি মো . রেজাউল করিম বলেন , ' এটি পুরোপুরি দাপ্তরিক বিষয় দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকার পেছনে অবশ্যই কিছু কারণ আছে । বিস্তারিত আলোচনা করেই সমাধান বের করতে হবে ।
অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ তথ্য বলছে, প্রথম দিকে কয়েকটি করে ওয়াকিটকি ব্যবহার করার কথা থাকলেও ২০১৮-১৯ সালে মাঠপর্যায়ে ব্যবহারের জন্য সর্বমোট ২৯২ টি ওয়াকিটকি সরবরাহ করা হয় । কিন্তু অধিকাংশ যন্ত্র শুরু থেকেই অচল । ঢাকার এক সহকারী পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন , ‘অভিযান পরিচালনার সময় ফোর্স কম , গাড়ি কম — এ অবস্থায় একমাত্র আশা-ভরসা ছিল ওয়াকিটকির ওপর । সেটা এখনো অকেজো । জরুরি মুহূর্তে যোগাযোগ করার কোনো উপায় থাকে না ।
’সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পুলিশ টেলিকম মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে দীর্ঘদিন ধরে রিপিটার বসানোর ক্ষেত্রে অসহযোগিতা করায় নিজেদের জন্য ঢাকা , রাজশাহী ও টেকনাফে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি টাওয়ার স্থাপন করে মাদক অধিদপ্তর ; কিন্তু সেগুলো এখনো নেটওয়ার্কিংয়ের আওতায় আনা হয়নি । অভিযানগুলোতে তদারকির দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা বলেন , ‘ ওয়াকিটকি না থাকায় আমরা বাধ্য হয়ে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন ব্যবহার করি । কখনো অপরিচিত প্ল্যাটফর্মেও যোগাযোগ করতে হয় , যা নিরাপত্তাঝুঁকি বাড়ায় । জরুরি মুহূর্তে সহকর্মীদের ডাকার সুযোগও হচ্ছে না । ' অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা মনে করেন , পুলিশের একজন উপমহাপরিদর্শক ( ডিআইজি ) পদমর্যাদার কর্মকর্তা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পরিচালক ( অপারেশন ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । তিনি পুলিশেরই কর্মকর্তা হওয়ায় এই টানাপোড়েন দূর করতে ব্যর্থতার দায় তাঁর ওপরও বর্তায় ।