
মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প (বিহারি ক্যাম্প)। এখানে থেকে কেউ কেউ আখের গোছালেও অন্ধকারাচ্ছন্ন ক্যাম্পের প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে বঞ্চনা আর কষ্টের গল্প। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অপরাধ আর অবহেলা তাদের নিত্যসঙ্গী। কবরের দৈর্ঘ্য যেখানে সোয়া পাঁচ ফুট বাই তিন ফুট। সেখানে এই ক্যাম্পের একেকটি ঘর ৬ ফুট বাই ১০ ফুট। এসব ঘরে বসবাস করেন ৫ থেকে ৮ জন সদস্য। ঘুমানোর সময় কবরের সমান জায়গাও জোটে না তাদের কারও কারও। শুধু এ ক্যাম্পই নয়, দেশের ৭০টি ক্যাম্পের লাখ লাখ বাসিন্দা এভাবেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ক্যাম্পের মানুষের নেই নাগরিক সুবিধা, নেই উন্নত জীবনের স্বপ্ন। ক্যাম্পবাসী বলছেন, যেখানে দিনের আলো পৌঁছানো দায়, সেখানে ভালো থাকার স্বপ্ন তো বিলাসিতা।
১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের পর উর্দুভাষী বিহারিদের জন্য মোহাম্মদপুরের বর্তমান ৩২ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় গড়ে তোলা হয় এই ক্যাম্প। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা রেড ক্রসের (জেনেভাভিত্তিক) সহায়তায় গড়ে উঠায় এর নাম হয় ‘জেনেভা ক্যাম্প’। মূলত পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার প্রত্যাশায় এখানে আশ্রয় নেন কয়েক হাজার বিহারি। সময় অনেক গড়িয়েছে, প্রজন্ম বদলেছে, কিন্তু তাদের ফিরে যাওয়া আর হয়নি। বর্তমানে এখানে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। সরু গলির ভেতর ছোট ছোট খুপরি ঘরে গাদাগাদি করে তাদের জীবনযাপন। রাতে পালা করে ঘুমাতে হয় কোনো কোনো পরিবারের সদস্যদের। নেই পর্যাপ্ত টয়লেট। নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষার সুযোগ নেই। তরুণদের জন্য নেই কর্মসংস্থান। ফলে ছোটবেলা থেকেই অনেকে জড়িয়ে পড়ছে মাদক, চুরি, ছিনতাই, খুনসহ নানা অপরাধে।
সরেজমিন জেনেভা ক্যাম্পে ঢুকতেই নাকে আসে ড্রেনের দুর্গন্ধ। সরু গলিগুলোতে বৃষ্টির পানি জমে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। ক্যাম্পে রয়েছে ৯টি ব্লক। প্রত্যেকটি ব্লকে সরু গলির দুপাশে দোতলা, তিনতলা, ৫ তলা ভবন। অপরিকল্পিতভাবে উপরে উঠেছে ভবনগুলো। এসব ভবনেই খুপরি ঘর। ৬ ফিট বাই ১০ ফিট। ক্যাম্পের গলিপথগুলো এতটাই সরু যে হাঁটতে গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগে। গলির ভেতরে আঁকাবাঁকা সরু আরও একাধিক গলি রয়েছে। এই ক্যাম্পে প্রায় চার হাজার খুপরি ঘর আছে।
ক্যাম্পের বাসিন্দা আবুল কাশেম জানান, ছোট্ট ঘরে রান্না, খাওয়া, ঘুম-সব এক জায়গায়। গ্যাস নেই, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নেই, ব্যক্তিগত কোনো স্থান নেই। খাটের ওপরে তিনজন, নিচে আরও তিনজন। কেউ মেঝেতে, কেউ দরজার সামনে পাটিতে ঘুমান। যাদের পরিবারে সদস্য বেশি তারা পালা করে ঘুমান। বিদ্যুৎ চলে গেলে রাত কাটাতে হয় বাইরে বসে। তিনি বলেন, নাগরিকত্ব বা ভোটাধিকার বিহারিদের জীবনে কোনো মর্যাদা আনেনি। ঘর নেই, কাজ নেই, সুবিধা নেই। এমন পরিবেশে বেড়ে উঠা শিশুরা বড় হয়ে অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে।
ক্যাম্পের বাসিন্দা আব্দুস সাত্তার সেলুনে কাজ করেন। দুই মেয়ে এক ছেলেসহ ৫ সদস্যের পরিবার তার। ছোট খাটের ওপরে দুই মেয়ে, নিচে স্বামী-স্ত্রী, ছেলে দরজার পাশে ঘুমায়। তিনি বলেন, ‘কী করব, কোথায় যাব? যা আয় করি, তা দিয়ে সংসারই চলে না।’
ক্যাম্পের একাধিক বাসিন্দা জানান, সরু গলিতে ড্রেনের পানি জমে থাকে। আবর্জনার গন্ধ, হাঁটা দায় গলিপথে। দিনে ছয়-সাত ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। সকাল হলে লাইন ধরে নারী-পুরুষ বাসা থেকে অন্তত ৩শ গজ দূরে পাবলিক টয়লেটে যান। নারী-পুরুষকে পাশাপাশি গোসল করতে হয় গণগোসলখানায়।
আলি হোসেন নামের একজন বাসিন্দা বলেন, স্বল্প পরিসরে বসবাস, পেশাগত সীমাবদ্ধতা, পানির অভাব-সব মিলিয়ে শারীরিক ও মানসিক চাপের মধ্যে থাকতে হয় ক্যাম্পের প্রতিটি পরিবারকে। ক্যাম্পে ছোট ছোট ব্যবসা কিংবা কাজ করে বাসিন্দারা সংসার চালান।
মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা মাহতাব হোসেন বলেন, এখানে শিক্ষার সুযোগ সীমিত। শিশুদের মধ্যে ৫-১০ শতাংশ আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পায়। বাকিরা ছোটবেলাতেই কাজ শিখে জীবিকা নির্বাহে যুক্ত হয়।
একজন বাসিন্দা জানান, মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে প্রায় ১২ হাজার ভোটার রয়েছেন। তারা শুধু রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হন। কিন্তু বিহারিদের পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। অধিকাংশ বিহারি এখনো আটকে পড়া পাকিস্তানি। নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের নাগরিক হলেও নিজেদের পরিচয় ও অস্তিত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে। একই চিত্র দেখা গেছে কালশির কুর্মিটোলা ক্যাম্পেও।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আটকে পড়া পাকিস্তানি তথা বিহারিদের প্রতিনিধিত্ব করতে ১৯৭৮ সালের ২ ডিসেম্বর এসপিজিআরসি (স্ট্রান্ডেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশনস কমিটি) নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরে এসপিজিআরসি ১৯৯২ সালে মক্কাভিত্তিক রাবেতা আল ইসলাম নামে একটি এনজিওর সঙ্গে যৌথভাবে বিহারিদের ওপর জরিপ চালায়। ওই জরিপ অনুযায়ী, দেশের ১৭ জেলায় ৭০টি বিহারি ক্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার মোহাম্মদপুরে ছয়টি ও মিরপুরে ২৫টি ক্যাম্প রয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জে ৩, যশোরে ৯, রংপুরে ২, রাজশাহীতে ২, চট্টগ্রামে ৫, ঈশ্বরদীতে ৪ ও খুলনায় ৫টি ক্যাম্প এবং বগুড়া, গাইবান্ধা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, ঠাকুরগাঁও, জামালপুর ও নীলফামারীতে একটি করে ক্যাম্প রয়েছে। জরিপ অনুযায়ী ওই সময় ক্যাম্পের জনসংখ্যা ছিল ২ লাখ সাড়ে ৩৭ হাজার। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ৭ লাখে দাঁড়িয়েছে।
স্ট্র্যান্ডেড পিপলস জেনারেল রিহ্যাবিলিটেশন কমিটির (এসপিজিআরসি) সভাপতি শওকত আলী বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা আগ্রহ নিয়ে বাংলা শিখছে, শিক্ষিতও হচ্ছে। কিন্তু তারা সম্মানজনক চাকরি পাচ্ছে না। তারা চায় বাংলাদেশেই থাকতে, পাকিস্তানে নয়। তিনি বলেন, ক্যাম্পের ছেলেমেয়েরা চায় পড়াশোনা করতে। কিন্তু দারিদ্র্য তাদের আটকে রাখে। তাই কেউ সেলুনে, কেউ গার্মেন্টে, কেউবা হোটেল বয়ের কাজ করে স্বপ্নের সঙ্গে আপস করে নেয়।