Image description

৫ই আগস্ট পট পরিবর্তনের পর দলের ইমেজ ধরে রাখতে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। দলের কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। বহিষ্কারের পাশাপাশি মামলা করার কথাও বলা হয় দলের পক্ষ থেকে। ঘোষণা অনুযায়ী শুরু থেকেই অভিযুক্ত নেতাকর্মীদের
বহিষ্কারসহ তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া শুরু করে বিএনপি। এ পর্যন্ত সাত হাজারের মতো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সারা দেশে। এত সংখ্যক নেতাকর্মীকে শাস্তি দিলেও অভিযোগ আসা থামছে না। এখনো দলের দপ্তরে প্রতিদিন আসছে নানা অভিযোগ। ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। যদিও অভিযুক্ত ও শাস্তি পাওয়া কিছু নেতাকর্মী পাল্টা অভিযোগ করছেন তাদের কোনো না কোনোভাবে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। দলের বা বিরোধী পক্ষের অপপ্রচারে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এমন অনেক নেতাকর্মী শাস্তি প্রত্যাহার চেয়ে দলের দপ্তরে আবেদনও করেছেন। 

দলীয় নেতারা জানিয়েছেন, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও অসদাচরণসহ নানা অভিযোগে শাস্তি পাওয়াদের কেউ পদচ্যুত হয়েছেন। আবার অনেকেই বহিষ্কৃত হয়েছেন। এর মধ্যে অনেকের আবেদনের প্রেক্ষিতে সাংগঠনিক ব্যবস্থা তুলে নেয়া হলেও নিজেকে শোধরাতে পারেননি। তারা আগের মতো অপকর্মে নিজেদের জড়িয়ে দলকে বিব্রত করছেন। 

দলীয় দপ্তরে জমা হওয়া একটি অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদীর বালু লুটের ডন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে তাহিরপুর উপজেলা বিএনপি’র নেতা ও জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটির সদস্য কামরুল ইসলাম ও আনিসুল হক। অভিযোগে বলা হয়, বিগত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করায় তাদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো মামলা পর্যন্ত হয়নি। আন্দোলনের সময়ে নানা অজুহাতে বিদেশে চলে যেতেন। ৫ই আগস্টের পরে যাদুকাটা নদীর বালুখেকো সিন্ডিকেটের প্রধান নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের গণযোগাযোগ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক শাহ রুবেল আহমদকে কব্জা করে বালুমহাল নিজের হাতে তুলে নেন কামরুল ও আনিসুল। রুবেল আহমদ আবার পুলিশের কর্মকর্তা ডিবি হারুনের ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন বলে এলাকায় আলোচনা আছে। ৫ই আগস্টের পর অবৈধ বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে সুনামগঞ্জে কামরুল ও আনিসুল গ্রুপের ওপর ভর করে রুবেল। এর মাধ্যমে বালুমহালের ব্যবসার পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন রুবেল। 

৫ই আগস্টের পরে তাহিরপুর উপজেলার বড়ছড়া বর্ডার, চারাগাঁও বর্ডার, বাগলী সীমান্ত এলাকা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন কামরুল ও আনিসুল। এ ছাড়া তাহিরপুর উপজেলার ডাম্পের বাজার খেয়াঘাট, শ্রীপুর বাজার, বাদাঘাট বাজার থেকে কামরুল ও আনিসুল গ্রুপের নামে চাঁদা তোলার অভিযোগ করা হয়েছে। 

অভিযোগের বিষয়ে কামরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আমার হাজার হাজার শ্রমিক আছে। শ্রমিকের জন্য আমি করছি। কিন্তু একটা পক্ষ আছে, যারা এটার বিরোধিতা করছে। আর অনেক জায়গায় অনেক অনিয়ম হচ্ছে। মাঠে যদি আমার বিরুদ্ধে একজন মানুষও বলেন তাহলে আমি মেনে নেবো। আমাকে আমার জনগণ এবং এলাকায় সাধারণ মানুষ নেতা বানিয়েছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে যখন যা করতে হয়, আমি তাই করি। আমি কোনো সাধারণ মানুষের বাইরে কিছু করি না। আমি ব্যবসায়ীও না। 
ওদিকে গত বছরের ২রা সেপ্টেম্বর এস আলম গ্রুপের ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি সরিয়ে নেয়ার ঘটনায় ওই সময়ে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, ১ম যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম এবং আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এস এম মামুন মিয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় বিএনপি বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করলে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তারা চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভও করেছেন। চট্টগ্রামের কয়েকজন বিএনপি নেতা মানবজমিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যবসা করেছেন এনাম। যার কারণে বিএনপি’র তৃণমূল কর্মীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। চাঁদাবাজি, শিল্প প্রতিষ্ঠান দখল, রাজনৈতিক আঁতাত ও অডিও ফাঁস- স্থানীয় নেতাকর্মীদের ক্ষোভে দলের ভাবমূর্তি এখন প্রশ্নের মুখে। এনামুল হক এনাম এখন স্থানীয় রাজনীতির সবচেয়ে সমালোচিত নাম। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত এবং সম্প্রতি একাধিক অডিও ফাঁসকে ঘিরে তাকে নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কোলাগাঁও এলাকার অন্তত ৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এনামের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-এনার্জি প্যাক পাওয়ার প্লান্ট, জুডিয়াক ৬০ মেগাওয়াট, আনলিমা, বাংলাদেশ স্প্রিং মিলস, রিজেন্ট, আল বারাকা ও আনলিমা পাওয়ার প্যাক। হাইদগাঁও ও কেলিশহর পাহাড়ি এলাকায় এনামের অনুসারী আবছার ও কালুর নেতৃত্বে গাছ কেটে বিক্রি করে ২ থেকে ৪ কোটি টাকার সম্পদ লুটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয়দের দাবি, এই চক্র পাহাড়ি এলাকায় চোলাই মদের ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করছে এনাম। ওদিকে এনামুল হক এনামকে ঘিরে বিতর্ক আরও ঘনীভূত হয় যখন দুটি অডিও ফাঁস প্রকাশ্যে আসে। প্রথম অডিও ৪ মিনিট ২৭ সেকেন্ডের, বিএনপি’র সদস্য সচিব খোরশেদ আলম এবং উপজেলা জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি সামশুল ইসলামের সঙ্গে এই কথোপকথন। এতে খোরশেদ সামশুলকে আশ্বস্ত করতে শোনা যায়-তিনি গ্রেপ্তার হবেন না, ভবিষ্যতেও কোনো মামলায় নাম আসবে না। খোরশেদ বলেন, এনাম ভাই বলেছেন, এটা টেকনিক্যালি কাভার করবেন। দ্বিতীয় অডিও ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডের- সামশুল ইসলাম ও সৌদি প্রবাসী জিয়াউল হকের কথোপকথনে উঠে আসে গাড়ির দাবি, তেলের ব্যবসায় ভাগ চাওয়ার প্রসঙ্গ এবং শিল্পের লাভের অঙ্ক ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা। সেখানে খোরশেদ আলম ও এনামের নামও আসে।

এনামুল হক এনামের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে উপজেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব খোরশেদ আলম মানবজমিনকে বলেন, আমি কেন উনাকে আশ্বস্ত করবো।  দলের নেতৃত্বে ছিলাম, একটা লোক তো আমাকে ফোন করতে পারে। আর সে এক সময় বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। উনি যখন থেকে আওয়ামী লীগে চলে গেছেন তখন থেকে আর উনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল না। হঠাৎ ফোন করে বললেন, তার বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে কেন? আমি বললাম, আমি কেমনে জানবো। আরও বললেন, আমি কি বাড়িতে থাকতো পারবো, আমি বললাম-আপনি থাকবেন- কে কি করবে। আমি কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ, তাকে বাড়িতে থাকতে মানা করতে পারি? পারি না। 

ওদিকে সম্প্রতি ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে শরিয়তপুর রুটে চলাচল করা শরিয়তপুর সুপার সার্ভিস নামের একটি পরিবহন কোম্পানির কাছে পাঁচ কোটি টাকা অথবা মাসে দশ লাখ টাকা চাঁদা দাবির একটি অভিযোগ ওঠে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জাতীয়তাবাদী যুবদলের যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক সহ-সভাপতি মুশফিকুর রহমান ফাহিমের বিরুদ্ধে। ১২ই জুলাই তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে বিজ্ঞপ্তি দেয় সংগঠনটি। এ ছাড়া ১২ই মে দলের নামে অফিস খুলে চাঁদাবাজির অভিযোগে নাটোরের সিংড়া থেকে পুলিশ আটক করে স্থানীয় বিএনপি নেতা হাজী কুদ্দুস আখন্দকে। তিনি উপজেলা মৎসজীবী দলের সাবেক সভাপতি। ২৮শে মে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় গরুর হাটে চাঁদাবাজির অভিযোগে আটক হন বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দুই নেতা। ২৯শে এপ্রিল নাটোরে ধানের ট্রাকে চাঁদাবাজির অভিযোগ আটক হন বিএনপি ও যুবদলের তিন নেতা। ১৩ই এপ্রিল পাবনার ঈশ্বরদীতে অটোরিকশার স্ট্যান্ড দখল নিয়ে বিএনপি’র দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার এমসি বাজারে উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম মাইকে ঘোষণা দিয়ে বাজার দখল করে চাঁদা দেয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের নির্দেশ দেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণার ভিডিও ভাইরাল হলে তাকে যুবদল থেকে বহিষ্কার করা হয়। 

বিএনপি’র দলীয় সূত্র জানিয়েছে, অপরাধের বিষয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। দলের নেতারা মনে করেন, যারা এসব কাজে জড়াচ্ছে তারা প্রকৃত দলের লোক নয়। দলকে ব্যবহার করে এসব লোক ব্যক্তিগত ফায়দা নিতে কাজ করছে।
বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মানবজমিনকে বলেন, সারা দেশে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার অভিযোগ আসা মাত্র আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। যে বা যারাই দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন কাজ করবে তাদের কোনো ছাড় নেই।