
ওমানের দুকুম সিদরা এলাকায় ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শাহাবুদ্দীনের একমাত্র মেয়ে আছিয়া বেগম। বয়স মাত্র চার মাস। এখনো বাবাকে ‘আব্বু’ বলে ডাকতে শেখেনি। কিন্তু তার ভাগ্যে জুটেছে বাবাহারা জীবনের নির্মম সূচনা। দাদা ছিদ্দিক আহমদ যখন ছোট্ট আছিয়াকে কোলে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন; গ্রামের বাতাসও যেন থমকে গিয়েছিল। আছিয়া তখন নির্বাক, অজান্তেই তাকিয়ে আছে সবার মুখের দিকে। সে জানেই না, তার জীবনের প্রথম শব্দ ‘আব্বু’ আর কোনোদিন উচ্চারণ করা হবে না।
বুধবার স্থানীয় সময় দুপুর ৩টা ২০ মিনিটের দিকে ওমানের দুখুম সিদরা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় শাহাবুদ্দীনসহ মোট আট বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে সাতজনই চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার ও অপরজন রাউজানের বাসিন্দা। তারা সাগরে মাছ ধরার কাজ করতেন। তবে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান গাড়ির চালক। এক উপজেলার সাত প্রবাসীর মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরে পুরো সন্দ্বীপ জুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। নিহতরা হলেন- সন্দ্বীপের সারকাইত ইউনিয়নের আলী আকবার সেরাংয়ের ছেলে মোহাম্মদ আমিন সওদাগর, শহীদ উল্লার ছেলে আরজু, ইব্রাহিম মিস্ত্রির ছেলে মোহাম্মদ রকি, মনু মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ বাবলু, ছিদ্দিক আহমেদের ছেলে শাহাবুদ্দীন, মাইটভাঙার জামাল উদ্দিনের ছেলে জুয়েল, রহমতপুরের মোশাররফ হোসেন রনি ও রাউজানের আলাউদ্দিন।
শাহাবুদ্দীনের বাবা ছিদ্দিক আহমদ বলেন, মাত্র ২১ দিন আগে ছুটি শেষ করে ওমানে যায় শাহাবুদ্দীন। ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছি সংসারের সুখের জন্য। আজ সে চলে গিয়ে সংসার শূন্য করে দিলো। শাহাবুদ্দীনের পাশেই বাবলুর ঘর। তার দুই সন্তানের বয়স চার বছরের নিচে। বুঝজ্ঞান হওয়ার আগেই বাবাকে হারিয়ে ফেললো তারা। রকির একমাত্র ছেলের বয়স ৫ মাস। বাবাকে শুধু ভিডিও কলে দেখতো। রকির স্ত্রী জানান, প্রতিদিন ভিডিওকলে ছেলেকে দেখে পিতৃত্বের স্বাদ মেটানোর চেষ্টা করতেন তিনি। মারা যাওয়ার আগের দিনও কল করেছিলেন। অবুঝ সন্তানটি মোবাইল দেখলে সব সময় বাবার ছবি খোঁজার চেষ্টা করে। দুই মাসের ছুটি কাটিয়ে ১ মাস ২১ দিন আগে ওমানে ফিরেছিলেন মোশাররফ হোসেন রনি। দেশে থাকা অবস্থায় ছোট্ট একটি চায়ের দোকান চালাতেন তিনি। টানাটানির সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা আনতে দুই বছর আগে ধার করে ওমানে যান। তবে ঋণ পুরোপুরি শোধ করার আগেই প্রাণ হারান তিনি।
রনির ভাই মোহাম্মদ জুয়েল বলেন, আমার ভাই বাড়িতে একটা চায়ের দোকান চালাতেন। দুই বছর আগে ঋণ করে ওমান যায়। এখনো পুরোপুরি টাকা শোধ হয়নি। আরও কিছু বাকি আছে। তার আগেই আমার ভাই দুনিয়া থেকে চলে গেল। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে বাবা ও স্ত্রীর সঙ্গে ভিডিওকলে কথা হয়েছে। পরিবারের সবার খোঁজখবর নিয়েছে। লাশ দ্রুত দেশে আনার আকুতি জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের সব স্বপ্নই শেষ। আমরা ভাইয়ের লাশটা দেখতে চাই। সরকারের কাছে আবেদন যেন অতিদ্রুত আমার ভাইয়ের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনে। পাশাপাশি পরিবারকে যেন পুনর্বাসন করে।
ছয় বছর ধরে ওমানে আছেন মাইটভাঙ্গা ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নিহত প্রবাসী জুয়েল। ৬-৭ মাস আগে ছুটিতে বাড়ি এসে পাকা ঘর নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি। জুয়েলের বাবা জামাল বলেন, আগামী সপ্তাহে তার প্রেরিত টাকা দিয়ে বিল্ডিংয়ের ছাদের কাজ শুরু করার কথা। ঘর তো হবে। কিন্তু সে ঘরে থাকবে কে? আপনাদের মাধ্যমে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের কাছে আমার জোর দাবি, দ্রুত আমার ছেলের মরদেহটা যেন দেশে পাঠানো হয়। তার তৈরি ভবনের সামনেই তার জানাজাটা করতে চাই।
এ বিষয়ে সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মংচিংনু মারমা জানান, নিহতদের মধ্যে ৫ জনই সারিকাইত ইউনিয়নের তরুণ শ্রমিক। একই এলাকার এতগুলো পরিবারের সদস্য নিহত হওয়ায় সারিকাইতে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া। সারিকাইত ইউপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তাছলিমা বেগম বলেন, পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। নিহতদের বাড়িতে চলছে আহাজারি ও শোকের মাতম। ওমানে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, দুর্ঘটনার পর দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। নিহতদের মরদেহ স্থানীয় হাসপাতালে রাখা হয়েছে। আইনি ও আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষ হলে যত দ্রুত সম্ভব মরদেহগুলো দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ দুর্ঘটনা গভীর শোকের সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ দূতাবাস নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছে এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে। এদিকে, ওমানের দুখুম পুলিশ জানিয়েছে, মাইক্রোবাস ও ফিশিং ট্রাকের মধ্যে সংঘর্ষের সঠিক কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত চলছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, অতিরিক্ত গতি ও দৃশ্যমানতার অভাবের কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।