Image description
 

সপ্তম শ্রেণির ছাত্র প্রতীক সরকার। বয়স ১৩ বছর। শিশুটি ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জের বাসা থেকে স্কুলের উদ্দেশে বের হয়ে শিকার হয় অপহরণের। তিন ঘণ্টা পর পাশের দোহার থানা এলাকায় একটি গাড়ির ভেতরে হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। গত বুধবার সকালের ওই ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় পাঁচজনকে। আগের দিন মঙ্গলবার রাতে বান্দরবানের লামায় সাত তামাক শ্রমিককে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা।

এ ছাড়াও চলতি বছরের শুরুতে গত কয়েক দিনে আরও বেশ কয়েকটি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীসহ সারা দেশে অপহরণ বা উঠিয়ে নিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে পার্বত্য এলাকায় অপহরণ আর মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Kiswan

একের পর এক এ ধরনের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আর উদ্বেগ বাড়ছে। ৫ আগস্টের পর সারা দেশের কারাগার থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিন লাভ, মাদকের ছড়াছড়ি এবং পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এই অপরাধ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম নেপথ্য কারণ বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। পুলিশ বলছে, অপহরণের ঘটনায় পেশাদার অপরাধীদের পাশাপাশি শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জড়িত থাকার তথ্যও তারা পাচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্রমতে, অপহরণের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গত বছরও অপহরণ ঘটনার সংখ্যা ছিল উল্লেখ করার মতো। গত বছর সারা দেশে অপহরণের ঘটনা ঘটে ৬৪২টি। এর মধ্যে কেবল রাজধানী ঢাকায়ই ১৩২টি অপহরণ সংঘটিত হয়। 

এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে রাজধানীতে ৬১টিসহ সারা দেশে অপহরণের ঘটনা ঘটে ৪৬৩টি। ২০২২ সালে সারা দেশে অপহরণের ঘটনা ঘটে ৪৬০টি, এর মধ্যে ঢাকায় ৪৯টি। 

চলতি বছরের শুরুতে যে হারে অপহরণের সংখ্যা প্রকাশ পাচ্ছে তাতে করে বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেকটা বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। সবশেষ ঘটনার ব্যাপারে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার সকালে ঢাকার নবাবগঞ্জে অপহরণের শিকার হয় স্থানীয় হলিক্রস উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র প্রতীক সরকার। এই ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হচ্ছেÑ শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার পারভেজ আহমেদ (৪০), রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার মোক্তার হোসেন আকাশ (৩৯) ও জুরাইন পশ্চিম দোলাইরপাড়ের জুম্মন খান (৪১), মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার আতিক হালদার (৪৪) ও চাঁদপুরের মিজান (৫৩)।

পুলিশ জানায়, প্রতীক সরকার উপজেলার নয়নশ্রী ইউনিয়নের ঘোষপাল এলাকার বাসিন্দা। সকাল ৯টার দিকে প্রতীক স্কুলের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি প্রাইভেটকার থেকে তাকে ডাক দেয় কয়েকজন। সে এগিয়ে গেলে অপহরণকারী চক্রের এক সদস্য প্রতীকের বাবা কোথায় জানতে চায়। এরপর বাড়ি দেখিয়ে দেওয়ার কথা বলে শিশুটিকে তার গাড়িতে তুলে নেয়। গাড়িটি নবাবগঞ্জ থেকে দোহার হয়ে শ্রীনগর মহাসড়কের দিকে যায়।

অন্যদিকে সকাল ১০টার পর বিদ্যালয় থেকে প্রতীকের অনুপস্থিতির বিষয়টি তার পরিবারকে জানানো হয়। এ অবস্থায় প্রতীকের বাবাসহ অন্য স্বজনরা দ্রুত বিষয়টি নবাবগঞ্জ থানা পুলিশকে জানান। পরে দোহার ও নবাবগঞ্জের প্রতিটি রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়ে গাড়ি তল্লাশি করা হয়।

পুলিশ সূত্রে আরও জানা গেছে, দুপুর ১২টার দিকে দোহার থানার সীমান্তবর্তী সাইনপুকুর তদন্তকেন্দ্রের কাছে প্রতীককে বহনকারী গাড়িটি আটকে দেয় পুলিশ। পরে গাড়ির ভেতর থেকে হাত, পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া স্কুলছাত্র প্রতীকসহ গ্রেপ্তার পাঁচজনকে নবাবগঞ্জ থানায় হস্তান্তর করা হয়।

পুলিশের একাধিক সূত্র বলছে, গত ৫ আগস্টের পর অপহরণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো যেসব অপরাধ ঘটছে তার সঙ্গে জড়িতদের বেশিরভাগই পেশাদার অপরাধী। শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায়ও পেশাদার অপরাধীরা সক্রিয়। পেশাদার অপরাধী ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের এই তৎপরতা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বিভিন্ন বৈঠকেও আলোচনা হচ্ছে।

সূত্র বলছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর সারা দেশের কারাগারে আটকে থাকা আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একটি বড় অংশ ছাড়া পেয়েছে। আর ওরা কারাগারের বাইরে এসেই পুনরায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু করেছে। এসব কারণে রাজধানীসহ সারা দেশে অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ বেড়েছে। জামিনে বেরিয়ে এসে অপরাধে জড়ানো শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে করণীয় নির্ধারণে কাজ চলছে। পাশাপাশি যেসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করার সাহস পাচ্ছেন না বলে খবর বেরিয়েছে, সেগুলো সম্পর্কেও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

র‌্যাব সূত্র জানায়, অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের ধরতে পুলিশের পাশাপাশি তারাও তৎপর। গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত শুধু র‌্যাবের অভিযানেই গ্রেপ্তার হয়েছে ১৩৫ জন অপহরণকারী। একই সময়ে অপহরণের শিকার ১৯৬ জনকে উদ্ধার করেছে র‌্যাব।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে অপহরণকারী চক্রের অনেকে গ্রেপ্তার হলেও এমন ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকা নিয়ে উদ্বেগ আর শঙ্কায় সাধারণ মানুষ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, নীতিনির্ধারণী মহল এবং সচেতন ব্যক্তিবর্গকেও ভাবাচ্ছে বিষয়টি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘নানাবিধ কারণে পুলিশ এখনও নেভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। আর পুলিশের এই নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে পেশাদার অপরাধীরা তৎপর হয়ে উঠেছে। অপরাধ মোকাবিলায় পুলিশের সক্রিয়তা এখন খুব জরুরি। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘পুলিশের সব সদস্য বিশেষ করে যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন তারা রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে করণীয় নির্ধারণে দোদুল্যমানতায় ভুগছেন। এ ছাড়া জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় সারা দেশে পুলিশের লুট হওয়া সহস্রাধিক অস্ত্র এখনও উদ্ধার হয়নি। ধরে নেওয়া যায়, এগুলো সন্ত্রাসীদের হাতে আছে এবং ব্যবহৃত হচ্ছে। 

এ ছাড়া স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায়ও পুলিশকে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ও যানবাহনের অভাবে সব কার্যক্রমেই বিঘ্ন ঘটছে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে নিয়মিত অভিযান চালাতে হচ্ছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন দাবিতে সড়ক অবরোধ, অবস্থান ও ঘেরাও কর্মসূচিতে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে পুলিশকে। একসঙ্গে এত কিছু সামলে নিতে বহুমুখী চ্যালেঞ্জে পড়েছে পুলিশ। পুলিশ সদস্যদের মনোবলও পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা যায়নি। সব মিলিয়ে পুলিশ এখনও এক ধরনের ট্রমায় আছে। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে অপরাধীরা। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘অপরাধের ধর্মই হচ্ছে কখনও বাড়ে কখনও কমে। পুলিশ সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী, পেশাদার সন্ত্রাসীসহ সব ধরনের সন্ত্রাসী, অপহরণকারী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে।

সাম্প্রতিক আলোচিত কিছু ঘটনা

কক্সবাজারের টেকনাফে গত সোমবার ভোরে নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার পথে অপহরণের শিকার হন বৃদ্ধ মোহাম্মদ শাকের। টানা ৩২ ঘণ্টা আটকে রাখার পর মঙ্গলবার দুপুরে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাংখালীর কম্বনিয়া পাহাড়ি এলাকায় তাকে ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা। তার ছেলে মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘বাবাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। অপহরণকারীরা ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। মুক্তিপণ আদায়ের জন্য ওরা তাকে শারীরিক নির্যাতন করেছে।’

কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও ভুক্তভোগীদের দেওয়া তথ্যমতে, গত এক বছরে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৯৩ জনকে অপহরণ করা হয়। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৭৮ জনকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেতে হয়েছে।

গত ৩ জানুয়ারি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কালাইয়া বন্দরে এক ব্যবসায়ীকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ এবং তার দোকানের কর্মচারীদের বেঁধে পাঁচ লাখ টাকা লুট করে নেয় দুর্বৃত্তরা।

গত ৫ জানুয়ারি সাতক্ষীরার শ্যামনগরের রামজীবনপুর গ্রামে খালুর বাড়িতে এসে এক নারী অপহরণের শিকার হন। বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে সাত-আটজন তাকে তুলে নিয়ে যায় এবং তার মোবাইল ফোন ব্যবহার করে পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে পরদিন ওই নারীকে উদ্ধার করে পুলিশ। এই ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় স্থানীয় দুই যুবদল নেতা জাকারিয়া ও তার সহযোগী মাসুম বিল্লাহকে।

গত ১১ জানুয়ারি গাজীপুরে অপহরণের শিকার হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের চিকিৎসক আমিনুর রহমান। চার ঘণ্টা পর মুক্তিপণের বিনিময়ে ছাড়া পান তিনি। অপহরণকারীরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তার পরিবারের কাছ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করে।

ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তা উড়ালসেতুর দক্ষিণ পাশে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন চিকিৎসক আমিনুর রহমান। এ সময় একটি সিলভার রঙের প্রাইভেটকার সেখানে থামে এবং তাকে ধাক্কা দিয়ে গাড়িতে তোলে। অপহরণের পরপরই তার চোখ স্কচটেপ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এরপর হাতুড়ি দিয়ে হাঁটুতে আঘাত করা হয় এবং তাকে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি গলায় রশি পেঁচানোর চেষ্টা করা হয়। 

অপহরণকারীরা প্রথমে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে তা তিন লাখে নামিয়ে আনা হয়। অপহরণকারীরা তার সঙ্গে থাকা ৯ হাজার ৫০০ টাকা, ক্রেডিট কার্ড, দুটি স্মার্টফোন ও একটি ল্যাপটপ কেড়ে নেয় এবং পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করে। এরপর চার ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়ে রাত সাড়ে ১১টার দিকে সালনা এলাকায় তাকে নামিয়ে দেওয়া হয়। 

কক্সবাজারের টেকনাফে গত ১৩ জানুয়ারি ভোরে নামাজ পড়তে বাসা থেকে বের হয়ে অপহরণের শিকার হন মালয়েশিয়া প্রবাসী মোহাম্মদ শাকের আহমদ (৬৫)। রাতে তার স্ত্রীর মোবাইলে এক ব্যক্তি ফোন করে অপহরণের কথা জানিয়ে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। লেনদেন পর্ব শেষে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মুক্ত হন তিনি। 

গত ১৪ জানুয়ারি ময়মনসিংহে টিউশন শেষে ফেরার পথে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সাজিদ হাসান অপহরণের শিকার হন। তাকে নির্যাতন করে মুক্তিপণ হিসেবে ৩০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। পরে অবশ্য পুলিশের তৎপরতায় অপহরণের সঙ্গে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার এবং মুক্তিপণের ২৪ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।

বান্দরবানের লামায় বমুখাল এলাকা থেকে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে ৭ তামাক শ্রমিককে অপহরণ করা হয়। তারা হলেনÑ মোহাম্মদ আমিন (৩৫), আলেক্স জোহার (৩৫), শফি আলম (৩২), সাকিব (১৪), জাভেদ (২৬), আসাদ (১৮) ও আবু হানিফ (২১)।