Image description
নিষ্ক্রিয় বিএনপিপন্থি কর্মকর্তারা, তৎপরতা বাড়ছে জামায়াতপন্থিদের, সচিব পদে নিয়োগ চূড়ান্ত হবে আজ

জনপ্রশাসন সচিব পদে নতুন নিয়োগ নিয়ে সরকারের ভেতরে দ্বিধা ও টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। বিএনপিপন্থী সরকারি কর্মকর্তারা নিষ্ক্রিয় থাকায় তাদের অনুগত কাউকে প্রশাসনের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে নিয়োগ দিতে দেরি হচ্ছে। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে জামায়াতপন্থী কর্মকর্তারা নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে এই গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে তৎপর হয়ে উঠেছেন। গত ১৪ মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এবং অধিদপ্তবের মহাপরিচালক পদসহ মাঠ প্রশাসনের ডিসি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পদ বাগিয়ে নিয়েছে জামায়াতপন্থীরা। অন্যদিকে, বিএনপিকে রাজনৈতিক মাঠে হাট-বাজার দখলদার বানিয়ে মিথ্যা প্রচারানা চালাচ্ছেন তারা। বিএনপির মাঠ সামলাতে ব্যস্ত থাকায় সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রশাসন, ব্যাংকসহ বিভিন্ন অফিস দখলও নিয়েছে জামায়াত। এদিকে জনপ্রশাসনের শীর্ষ পদটি এখন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক টানাপোড়েনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। নিষ্ক্রিয়তার দায়ে বিএনপিপন্থী কর্মকর্তারা পিছিয়ে পড়েছেন। আবার কিছু উপদেষ্টার আস্তাভাজন কর্মকর্তার সুপারিশের পাল্লা ভারী হয়েছে। তৎপরতার জোরে অন্য একটি গোষ্ঠী অনেকটা এগিয়ে গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত কে হচ্ছেন জনপ্রশাসন সচিব, সেটিই এখন প্রশাসনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। তবে আজ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক রয়েছে। সেই বৈঠকে জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানা গেছে।

ব‍্যাপক অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানকে গত ২১ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে বদলি করা হয়। সেদিনই তিনি বিদায় নেন। তার বিদায়ের পর থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ সচিব নেই ১৮দিন ধরে। এদিকে প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের সফর শেষে দেশে ফিরে অফিস করছেন। প্রধান উপদেষ্টা দেশে আসার পর থেকে জনপ্রশাসনে নতুন সচিব নিয়োগে তালিকা চূড়ান্ত করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগ নিয়ে উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে টানাপোড়েন শুরু হয়। আবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে যেসব কর্মকর্তাদের নামের তালিকা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেক কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিচালনায় অদক্ষ এবং অনভিজ্ঞ বলে মনে করে প্রধান উদেষ্টার কার্যালয় থেকে ফাইল ফেরত দেওয়া হয়েছে। নতুন করে আবারো গোযেন্দা তথ্য নেয়া হচ্ছে। আজ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগ নিয়ে চূড়ান্ত বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। তালিকাভুক্ত ছয়-সাতজন কর্মকর্তার মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেওয়া হবে। তবে পরিস্থিতি যেমন জটিল, তাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। উপদেষ্টাদের মধ্যে মতৈক্য না এলে বিষয়টি আবারও প্রধান উপদেষ্টার হাতে ফিরতে পারে। প্রশাসনের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, এই মুহূর্তে সবাই অপেক্ষায়। কে হচ্ছেন জনপ্রশাসন সচিব, তার ওপরই পরবর্তী প্রশাসনিক কাঠামো নির্ভর করছে। সবাই জানে, এটা শুধু একটা নিয়োগ নয় ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারণের বিষয়ও।

এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সভাপতি এবং সাবেক সচিব এ বি এম আবদুস সাত্তার ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের দাবি হচ্ছে একজন দক্ষ, সৎ-মেধাবী এবং প্রশাসন পরিচালনায় অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের জনপ্রশাসন সচিব পদে দেখতে চাই। চিহ্নিত কোনো একটি রাজনৈতিক দলপন্থী আমলা নিয়োগ দেয়া হলে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে, তার আগে একজন দক্ষ কর্মকর্তাকে আমরা দেখতে চাই। বিগত দিনে জনপ্রশাসন সচিব নিয়ে নানা অনিয়ম ও বির্তক রয়েছে। সেগুলো বিবেচনা করে প্রধান উপদেষ্টা একজন ভালো কর্মকর্তা নিয়োগ দিবেন। কে কি বললো তা দেখার বিষয় নয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের দপ্তরের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, সচিব নিয়োগের চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুতের কাজ কয়েক সপ্তাহ ধরেই আটকে আছে। তবে সম্প্রতি একাধিক উপদেষ্টা পর্যায়ের কর্মকর্তা তাঁদের পছন্দের কর্মকর্তাদের নামের তালিকা প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছেন। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবের দোলাচলে এই নিয়োগই এখন সরকারের ভেতরে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।

বিএনপিপন্থী কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয়তা : প্রশাসনের ভেতরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা মনে করেন, আগের আমলে গুরুত্ব পাওয়া বিএনপিপন্থী কর্মকর্তারা এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে তারা পিছিয়ে পড়েছেন। এর আগে সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম কে আনেয়ার মারা যাওয়ার পর থেকে গত ১৬ বছর ধরে প্রশাসনের দেখভাল করে আসছিলো সাবেক সিনিয়র সচিব এ বিএম আব্দুল সাত্তার, সাবেক সচিব বিজন কান্তী, সাবেক সচিব আব্দুল বারী, সাবেক সচিব আব্দুল খালেক, সাবেক সচিব সামছুল আলম। এদিকে সাবেক সচিব আব্দুস সাত্তার অফিসার্স ক্লাবের দায়িত্ব নেয়ার পরে প্রশাসনের দেখভাল করার দায়িত্ব দেয়া হয় বিএনপির চেয়ারপাসনের উপদেষ্টা সাবেক সচিব ইসমাইল জবিউল্লাহ এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিনকে। এরপরেও প্রশাসনে কে কি করছে তা ধরতে পারছে না বিএনপি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র সচিব বলেন, যারা আগের সরকারে পেছনের সারিতে ছিলেন, তারাই এখন নীরব। তারা তালিকা তৈরিতে আগ্রহী নয়, আবার আলোচনাতেও সক্রিয় নন। ফলে জনপ্রশাসন সচিব পদে তাদের প্রভাব অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। এই নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিচ্ছে অন্য গোষ্ঠী। তারা এখন উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে, প্রস্তাবনা দিচ্ছে এবং নিয়োগের সম্ভাব্য নামের তালিকা সাজাচ্ছে। পছন্দের কর্মকর্তাদের তালিকা হাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, বর্তমানে সচিব পদে কয়েকজনের নাম আলোচনায় রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব মো. নজরুল ইসলাম (১১তম ব্যাচ), স্থানীয় সরকার সচিব রেজাউল মাকসুদ জাহিদ (১৩তম ব্যাচ), অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শাহরিয়ার কবির, এবং চুক্তিভিত্তিক দায়িত্বে থাকা ড. সালেহ আহমেদ, এহসানুল হক, সাবেক সচিব আব্দুল খালেক ও সামছুল আলম। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে সম্প্রতি এই নামগুলোর একটি খসড়া তালিকা পাঠানো হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। তবে কোনো নামেই এখনও চূড়ান্ত অনুমোদন হয়নি। প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, এখন বিষয়টা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। কারা উপদেষ্টার কাছে ঘনিষ্ঠ, কার প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন রয়েছে, তা-ই নিয়োগের চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণ করবে। তারা আরো মনে করেন, আগামী নির্বাচনের আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে একজন দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তাকে নিয়োগ না দিলে আবারো ভুল করবে সরকার। একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে প্রশাসনের এমন অচলাবস্থা সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু এবার ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার অধীনে থাকা একাধিক উপদেষ্টা ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অঘোষিত প্রতিযোগিতা চলছে, কে নিজের পছন্দের কর্মকর্তাকে নিয়োগে আনতে পারেন। এক উপদেষ্টা দপ্তরের একজন কর্মকর্তার ভাষায়, এখন ফাইল নিয়ে যে উপদেষ্টা বেশি সক্রিয়, তিনিই তালিকায় প্রভাব ফেলছেন। কেউ কারো ফাইল নিচ্ছেন না, আবার কেউ কেউ প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনের আগে নিজের মন্তব্য জুড়ে দিচ্ছেন। এই অবস্থায় প্রশাসনের ভেতরে লবিং বেড়েছে কয়েকগুণ। কর্মকর্তারা উপদেষ্টাদের বাসভবনে দেখা করছেন, ব্যক্তিগত সম্পর্ক কাজে লাগাচ্ছেন। এমনকি কিছু কর্মকর্তা নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে নিজের নাম তালিকা থেকে সরিয়ে নিতে চাচ্ছেন।

বিভাজনের কেন্দ্র চুক্তিভিত্তিক না পদোন্নতিতে : এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মূল বিভাজন তৈরি হয়েছে চুক্তিভিত্তিক না পদোন্নতিভিত্তিক নিয়োগে। প্রশাসনের এক অংশ বলছে, অবসরপ্রাপ্ত কোনো অভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে চুক্তিতে এনে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি। অন্য অংশ বলছে, এতে সিনিয়র ব্যাচের কর্মকর্তারা বঞ্চিত হবেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক সচিব বলেন, মাঠ প্রশাসনের অভিজ্ঞ, দক্ষ, মেধাবী, দাপটের এবং প্রশাসনের সকল মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তাকে জনপ্রশাসনে নিয়োগ দেয়ার দরকার। এই সময়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে নারী সচিব করা হলে ‘যে লাউ, সেই মকলেছ, সেই কদু’ হবে। চুক্তিতে আনলে তরুণ ব্যাচগুলো হতাশ হলেও তা বর্তমান সরকারে কিছুই করার নেই। আবার নতুন কাউকে দিলে অভিজ্ঞতার ঘাটতি দেখা দেয়। কিন্ত এখন যেভাবে লবিং চলছে, তাতে যোগ্যতার চেয়ে প্রভাবই বড় হয়ে উঠেছে।

উপদেষ্টাদের মধ্যে মতানৈক্য : প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ভেতরও এই নিয়োগ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। একজন উপদেষ্টা চান প্রশাসনের ‘নিরপেক্ষ’ ভাবমূূর্তির কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিতে। অন্যজন বলছেন, সরকার পরিচালনায় অভিজ্ঞ কেউ দরকার। এই মতবিরোধে ফাইল ফেরত যাচ্ছে, অনুমোদন আটকে থাকছে। এক সূত্র বলছে, সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্ট দুই উপদেষ্টাকে বৈঠকে ডেকে নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু বৈঠকের পরও কোনো ঐকমত্য হয়নি।

মাঠ প্রশাসনেও প্রভাব : এই জটিলতা শুধু সচিব নিয়োগেই সীমাবদ্ধ নয়। মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো যেমন জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও বিভাগীয় কমিশনারদের বদলি তাতেও প্রভাব ফেলছে। যেসব ডিসি আগামী মাসে বদলির অপেক্ষায়, তারাও এখন ধোঁয়াশায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জেলা প্রশাসক বলেন, ঊর্ধ্বতন পদে নিয়োগ না হলে নিচের বদলিও ঝুলে থাকে। কারণ, নতুন সচিব এলে তার পছন্দ অনুযায়ী পদায়ন হয়। এই অনিশ্চয়তায় প্রশাসনের ভেতর মনোবলও কিছুটা কমে গেছে।

অবসরপ্রাপ্ত সচিব আব্দুস সবুর ইনকিলাবকে বলেন, জনপ্রশাসন সচিব হচ্ছেন প্রশাসনের নীতিনির্ধারণী মাথা। সেখানে নিয়োগ যদি প্রভাবিত হয়, তবে নিচের সারির কর্মকর্তা পর্যন্ত তার প্রভাব পড়ে। নিরপেক্ষ সরকারের জন্য এটি বড় পরীক্ষা।