Image description

আরিফুল হক উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানিকে বেছে নিয়েছিলেন। মাস্টার্সের আবেদনের জন্য তিনি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে অ্যাপয়েন্টমেন্টের তারিখ নেন। এরপর কেটে গেছে একে একে দুই বছর। দূতাবাস থেকে ফিরতি মেইল পান ২০২৫ সালের মে মাসে। এরপর তিনি ভিসা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ভিএফএস (ভিসা ফ্যাসিলেশন সার্ভিসেস) গ্লোবালে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেন। পুরো প্রক্রিয়ায় সময় লেগেছে প্রায় আড়াই বছর। তিনি বলেন, ‘‘জার্মানিতে যারা পড়তে যাবেন, তাদের প্রতি পরামর্শ—একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেন অফার লেটার ম্যানেজ করে রাখেন। কারণ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রি আবেদনের সুযোগ আছে।’’  

শুধু জার্মানি নয়, ভিসা জটিলতায় ইউরোপের অনেক দেশেই উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ক্ষীণ হয়ে আসছে। তবে শুধু জার্মানিতে ভিসা আবেদনে ব্যয় হয় লম্বা সময়। জার্মান দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, তারা বছরে ২ হাজার আবেদন প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে। কিন্তু এর বিপরীতে প্রায় ৪০ গুণ আবেদন জমা পড়ে জার্মান দূতাবাসে। যে কারণে এই ধীরগতি।

গত বছরের ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র (আইভিএসি) অনির্দিষ্টকালের জন্য ভিসা কার্যক্রম সীমিত রেখেছে। শিক্ষার্থীদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে আবেদনের জন্য দিল্লি যাওয়ার প্রয়োজন হয়। ফলে ভারতের ডাবল এন্ট্রি ভিসার প্রয়োজন পড়ে। এ কারণে অনেক শিক্ষার্থীই বিপাকে পড়ছেন। বাংলাদেশে পর্তুগাল, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, লিথয়ানিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দূতাবাস নেই। তাই এসব দেশে পড়তে যেতে চাইলে শিক্ষার্থীদের নিকটবর্তী দেশ ভারতে গিয়ে ভিসা সাক্ষাৎকার দিতে হয়। 

দিল্লির বিকল্প হিসেবে ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনামের দূতাবাস থেকে কিছু দেশের ভিসা আবেদনের ব্যবস্থা করা হলেও এই দুই দেশের ভিসাই সীমিত হয়ে গেছে বাংলাদেশিদের জন্য।  

জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার আশা ছেড়ে দিয়েছেন আবির। তিনি জানান, অ্যাম্বাসি যেভাবেই ভিসা প্রসেস করুক না কেন, তাদের ক্যাপাসিটি না বাড়ালে অবস্থার উন্নতি হবে না। আগের আবেদন প্রসেস করতে করতে কয়েক বছর চলে যাবে, তাতে জার্মানি যাওয়ার ইচ্ছা নষ্ট হয়ে যাবে।

অপর এক শিক্ষার্থী জানান, স্টুডেন্ট ভিসার জন্য জার্মান দূতাবাসে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার প্রায় ৫০০ দিনের বেশি হয়ে গেছে আমার। এতদিন পরও দূতাবাস থেকে কোনও ধরনের রেসপন্স নেই। আমি অনুরোধ করবো—যারা ভুয়া অফার লেটার দিয়ে আবেদন করেন, তারা এই কাজ থেকে বিগত থাকলে অনেকের জন্য সুযোগ তৈরি হবে।

এসব বিষয়ে জানতে ঢাকার জার্মান দূতাবাসে ই-মেইল করা হলেও কোনও জবাব পাওয়া যায়নি। তবে দূতাবাসের ফেসবুক পেজে কিছু দিন পর পর ভিসা সংক্রান্ত আপডেট তুলে ধরা হয়। সর্বশেষ গত ১ অক্টোবর জার্মান দূতাবাস জানায়, ‘‘যেহেতু ভিসা বিভাগটি বর্তমানে খুব বেশি পরিমাণে অনুরোধের মুখোমুখি হচ্ছে—তাই আমরা দয়া করে আবেদনকারীদের ই-মেইল অনুসন্ধানগুলো প্রেরণ করা থেকে বিরত থাকতে বলছি। যা ইতোমধ্যে আমাদের ওয়েবসাইটের সঙ্গে পরামর্শ করে উত্তর দেওয়া যেতে পারে। এটি আমাদের আরও দক্ষতার সঙ্গে ঘটনাগুলো প্রক্রিয়া করতে সহায়তা করে এবং নিশ্চিত করে যে আমরা আবেদনগুলো যাচাইবাছাই করার জন্য আমাদের সীমিত ক্ষমতা ব্যয় করতে পারি। দয়া করে মনে রাখবেন যে এই ধরনের অনুসন্ধানের উত্তর দেওয়া হবে না।’’

এর আগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর জার্মান দূতাবাস জানায়, আবেদনকারীদের বিশেষ অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য যোগাযোগ করা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। ন্যায্যতার কারণে, দূতাবাস কঠোরভাবে অপেক্ষমাণ তালিকা মেনে চলে এবং ব্যতিক্রম করতে পারে না।’’

বাংলাদেশে পূর্ব ইউরোপের কোনও দেশের দূতাবাস নেই। ওইসব দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য দিল্লিতে অবস্থিত তাদের দূতাবাসে শিক্ষার্থীদের আবেদন করতে হয়। এসব দেশে ভিসার আবেদনের জন্য আবেদনকারীকে বেশ কিছু দিন দিল্লিতে অবস্থান করতে হয়। তাতে যোগ হয় অতিরিক্ত খরচ। শিক্ষার্থীদের মতে, সেসব দেশের ভিসা আবেদনের জন্য অন্তত ২০ দিন দিল্লিতে অবস্থান করা লাগে।

মধ্য ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়ার ভিসা অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে দেশটিতে আবেদনকারী একজন শিক্ষার্থী জানান, তিনবার অন্তত ভারতে যাওয়া লাগবেই, এছাড়া কোনও বিকল্প নেই। দ্বিতীয়বার দূতাবাস লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেয়।

ভিসা জটিলতা নিয়ে ঢাকায় ইউরোপগামী একদল শিক্ষার্থী গত বছর মানববন্ধন করেন। তারা জানান, ‘‘বিগত বছরের মতো এবারও হাজারো শিক্ষার্থী ইউরোপে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে চান। এজন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার আসার পর টিউশন ফি পরিশোধ করে— সবশেষ যে ধাপটার সম্মুখীন হতে হয়,  তা হচ্ছে ভিসা সাক্ষাৎকার।  

তাদের মতে, বিগত সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতার মধ্যে অন্যতম একটি ব্যর্থতা হচ্ছে— ইউরোপ মহাদেশের বেশিরভাগ দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে আনতে না পারা। ফলে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভারতে গিয়ে ভিসার সাক্ষাৎকারের সম্মুখীন হতে হয়। ভারতে ভিসা সাক্ষাৎকারের জন্য প্রবেশ করতে গেলে তাদের দেশের নিয়ম অনুযায়ী ডাবল এন্ট্রি ভিসা করতে হয়। কিন্তু তাদের শর্ত অনুযায়ী সব বৈধ প্রমাণপত্র দেওয়ার পরও ভারত বিনা কারণেই ডাবল এন্ট্রি ভিসা প্রত্যাখ্যান করে দেয়। এতে যেমন শিক্ষার্থীদের সময় নষ্ট হয়, তেমনই আর্থিক দিক দিয়েও তারা ক্ষতির সম্মুখীন হন।

শিক্ষার্থীরা জানান, বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী স্কলারশিপ পাওয়ার পরও তাদের এই ডাবল এন্ট্রি ভিসা জটিলতার জন্য নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন না। পাশাপাশি যারা নিজস্ব অর্থায়নে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে টিউশন ফি দিয়ে থাকেন, তারা নির্দিষ্ট সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পারলে টিউশন ফি’ও ফেরত দেয় না অনেক ক্ষেত্রে।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ‘‘জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা উচ্চমানের এবং ফ্রি। এ কারণে বাংলাদেশি ছাত্ররা জার্মানি যাওয়ার জন্য প্রচণ্ড আগ্রহী। ৮০ হাজার আবেদন জমা পড়েছে জার্মান দূতাবাসে। জার্মানির রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি চলে গেছেন। তিনি বলে গেছেন, আসলে তার কিছুই করার নেই। তাদের সামর্থ্য হচ্ছে প্রতিবছর ২ হাজার আবেদন নিষ্পত্তি করা। তার মানে—তারা এই পরিমাণ আবেদন হ্যান্ডেল করতে পারবেন না।

উপদেষ্টা বলেন, ‘‘আমরা জার্মানিকে অনুরোধ করেছি, পাকিস্তান থেকে তারা ৯ হাজার শিক্ষার্থী নেয় প্রতিবছর। বাংলাদেশ থেকে যেন সেই পরিমাণ নেয়। আমরা চেষ্টা করছি, এটা করা যায় কিনা।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘উচ্চশিক্ষা আর কাজের জন্য দূতাবাসে উপস্থিত হয়ে ভিসা নিতে হয়। এটা নিয়েও আমরা অনেক সমস্যার মধ্যে আছি। কারণ, আমাদের এখানে অনেক দেশের রাষ্ট্রদূত নেই। তাদের অফিস দিল্লিতে। মুশকিল হচ্ছে, ভারতের ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে আমাদের জন্য। এটা নিয়ে আমরা অনেক ভুগছি। আমরা চেষ্টা করছি এটাকে ডাইভারসিফাই করা যায় কিনা।’’