Image description

সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির নতুন পরিকল্পনা বাংলাদেশের ভূখণ্ড বিচ্ছিন্ন করা। বান্দরবানের বিভিন্ন সীমান্তপথ ও টেকনাফে আরাকান আর্মির সদস্যদের চলাচল বহুগুণ বেড়েছে। পাহাড়ে আত্তীকরণ, অবাধ যাতায়াত এবং অস্ত্র আদান-প্রদানের মতো কর্মকাণ্ড তাদের কৌশলের অংশ হয়ে উঠেছে।

 

রাখাইন রাজ্যের সীমান্তে মিয়ানমার সেনা ও বর্ডার গার্ড পুলিশের ব্যাটালিয়ন দখলের পর বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারে আধিপত্য বিস্তার করছে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। অস্ত্র মজুদ, মাদক পাচার থেকে শুরু করে রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংস নির্যাতন- এসবই তাদের নিত্যদিনের কার্যক্রম। কিন্তু এবার তাদের নতুন পরিকল্পনা বাংলাদেশের ভূখণ্ড বিচ্ছিন্ন করা। বান্দরবানের বিভিন্ন সীমান্তপথ ও টেকনাফে আরাকান আর্মির সদস্যদের চলাচল বহুগুণ বেড়েছে। পাহাড়ে আত্তীকরণ, অবাধ যাতায়াত এবং অস্ত্র আদান-প্রদানের মতো কর্মকাণ্ড তাদের কৌশলের অংশ হয়ে উঠেছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, সীমান্তবর্তী পাহাড়ি উপজাতিদের আরাকান আর্মি মিয়ানমারে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। পরে তারা আবার সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, এই সব কার্যক্রমের পেছনে রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। প্রভাবশালী দু’টি দেশ মিয়ানমারের রাখাইন ও বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে নিতে আরাকান আর্মিকে সহযোগিতা করছে। সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে নিলে বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা সহজ হবে- এমন ধারণা থেকেই তাদের এই পরিকল্পনা।

আরাকান আর্মির শক্তি বৃদ্ধি : ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রাখাইনে মিয়ানমার সেনা ও বিজিপির সাথে আরাকান আর্মির রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। একের পর এক আক্রমণে মিয়ানমার সেনার দু’টি ডিভিশন ও বিজিপির ১০টি ব্যাটালিয়ন ধ্বংস হয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। তাদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, মর্টার, গোলাবারুদ এবং কিছু সাঁজোয়া যান এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। বর্তমানে রাখাইনের ২৭১ কিলোমিটার এলাকা তাদের দখলে।

সীমান্ত অনুপ্রবেশ ও বিকল্প রুট : সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি নাইক্ষ্যংছড়ির ইয়াংনী পাড়ায় ২০ জন মুরং উপজাতি সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। থানচি উপজেলার রেমাক্রি, তিন্দু ও বড় মদক বাজার হয়ে তারা যাতায়াত করছে। আলীকদম সীমান্তেও মেনচংপাড়া হয়ে প্রবেশ করছে আরাকান আর্মির সদস্যরা।

বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি : আরাকান আর্মির শক্তি বর্তমানে প্রায় ৪৫ হাজার, যার মধ্যে ১৫ হাজার রাখাইন ও চিন প্রদেশে অবস্থান করছে। তাদের ক্ষুদ্রাস্ত্র উৎপাদন কারখানাও রয়েছে। ফলে সীমান্ত এলাকায় তাদের অবাধ যাতায়াত বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। তা ছাড়া উপজাতি সম্প্রদায়ের সাথে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত মিল থাকায় আত্মীয়তার বন্ধনে তাদের অবস্থান আরো মজবুত হচ্ছে। অনেক আরাকান যোদ্ধা স্থানীয় উপজাতি নারীদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে স্থায়ী আশ্রয় নিচ্ছে। ইউপিডিএফ (মূল) সম্প্রতি রকেট লঞ্চারসহ ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করেছে বলেও গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে।

অভ্যন্তরীণ সম্পৃক্ততা : গত এপ্রিল বান্দরবানের থানচিতে মাহা সাংগ্রাই উৎসবে তিন শতাধিক আরাকান আর্মি সদস্য প্রকাশ্যে অংশ নেয়। রাজনৈতিক শাখা ‘ইউনাইটেড লিগ অফ আরাকান’-এর নেতাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা স্থানীয় পর্যায়ে কিয়াং ঘর নির্মাণ, বসতি স্থাপন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করে দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে।

অস্ত্র, মাদক ও মানবপাচার : আরাকান আর্মি সীমান্ত দিয়ে অবাধে অস্ত্র ও মাদক পাচার করছে। মেনচং পাড়া-আলীকদম-চকরিয়া এবং চন্দক পাড়া-থানচি সড়ককে তারা পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। একইসাথে রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে ইয়াবা ও অস্ত্র পাচারও চালাচ্ছে।

ম্রো ও মারমা জনগোষ্ঠীর উপর প্রভাব : পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ম্রো ও মারমা সম্প্রদায়ের সাথে আরাকান আর্মি তথা রাখাইনদের সাংস্কৃতিক ও জাতিগত সাদৃশ্য রয়েছে, যা অত্যন্ত সংবেদনশীল। সম্প্রতি আরাকান আর্মির সদস্যরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বান্দরবানে বেশ কয়েকটি কিয়াং ঘর বসবাসের জন্য বাসস্থান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছে। সম্প্রতি লে. কর্নেল লাজেকে বেশ কিছু সামাজিক কর্মসূচিতে যোগ দিতে দেখা গেছে যেখানে তিনি মারমাদের অভিবাসন ও আরাকান আর্মিতে যোগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র্র পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণে নিতে ধর্ম পরিবর্তনসহ আগ্নেয়াস্ত্র বৃদ্ধি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এর সব কিছুর নেপথ্যে রয়েছে আরাকান আর্মি ও ইউপিডিএফ।

আরাকান আর্মি সদস্যের বিজিবির কাছে আত্মসমর্পণ : গত ১১ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রনি তঞ্চঙ্গ্যা একটি রাইফেল এবং ৫২ রাউন্ড অ্যামোনিশনসহ ৬৪ বিজিবির অধীনস্থ বিএসপি পোস্টে আত্মসমর্পণ করে। মংডু টাউনশিপের সীমান্তবর্তী চার মাইল এলাকায় আরাকান আর্মির ক্যাম্পে রনি তঞ্চঙ্গ্যাকে তিন মাস মেয়াদি সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এ সময়ে রনি তঞ্চঙ্গ্যা একে-৪৭, পিস্তল, স্নাইপার ও আরপিজি অস্ত্রের ব্যবহার ও বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। আরাকান আর্মিতে যোগদানের জন্য তাকে অর্ধ লক্ষ কিয়াত (মিয়ানমারের মুদ্রা) বেতন প্রদান করা হতো এবং রনি তঞ্চঙ্গ্যা অফিসার ছিলেন বলে জানান। তার ভাষ্যমতে, আরাকান আর্মি বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জায়গায় আরসা ও আরএসও যাতায়াত রোধের জন্য মাইন স্থাপন করেছে।

আরাকান আর্মির রবি সিম ব্যবহার : বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অংশে রবি সিমের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় এবং অধিকাংশ আরাকান আর্মির সদস্য রবি সিম ব্যবহার করে। আরাকান আর্মির সদস্যদের নিকট হতে উখিয়ার কোর্টবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু এলাকা এবং সীমান্ত পিলার এলাকা ব্যবহার করে অস্ত্র ও ইয়াবা পাচার করে নিয়ে যায়। এ ছাড়াও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপে বর্তমানে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ বাংলাদেশি উপজাতি বিশেষ করে চাকমা, মারমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের নাগরিক আরাকান আর্মি সদস্য হিসেবে কাজ করছে। বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার আনুমানিক ১৫০ থেকে ২০০ জন, বান্দরবান সদরের আনুমানিক ৮০ থেকে ১০০ জন, রুমার ১০ থেকে ২০ জন ও নাইক্ষ্যংছড়ির ২০ থেকে ৪০ জন আরাকান আর্মির সদস্য হিসেবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দায়িত্ব পালন করছে।

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ : গত ছয় মাসে অন্তত দেড় লাখ রোহিঙ্গাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে আরাকান আর্মি। এদের কেউ শরণার্থী শিবিরে নিবন্ধিত হয়েছেন, কেউ আত্মীয়স্বজনদের ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন- গোটা পরিস্থিতি এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক শক্তির মদদে আরাকান আর্মি সীমান্তবর্তী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করছে। অস্ত্র, মাদক, মানবপাচার ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট করা তাদের মূল লক্ষ্য। সীমান্ত সুরক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।