
উজান থেকে তিস্তার নেমে আসা পানিতে দু’কূলের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের বাসাবাড়ি তলিয়ে যাচ্ছে। রোববার (৫ অক্টোবর) দিবাগত মধ্যরাতে বাসাবাড়িতে উঠেছে কোমর পর্যন্ত পানি। যাতায়াত ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
ভারতের গজলডোবা ব্যারেজের সবকটি গেট খুলে দেয়া এবং ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে উজানের পানি আছড়ে পড়েছে তিস্তার বাংলাদেশের ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টে। ফলে এই বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েও কোনো কুল-কিনারা করতে পারছে না পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
ডালিয়া ব্যারেজের পূর্ব পাশে ফ্লাড বাইপাসের উপর দিয়েও বইছে তিস্তার পানি। যেকোনো মুহূর্তে তা ভেঙ্গে যেতে পারে। পরিস্থিতি সামাল দিতে অববাহিকায় রেড অ্যালার্ট জারি করেছে প্রশাসন। মাইকিং করে সতর্ক করা হচ্ছে অববাহিকার দুই পাড়ের বাসিন্দাদের।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, রোববার রাত ১২টায় তিস্তার পানি ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। রাত ১০টা যা ছিল ৩০, ৮টায় ২৯ এবং সন্ধ্যা ৬টায় ১০ সেন্টিমিটার উপরে। তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে ৪ অক্টোবর সকাল ৯টা থেকে ৫ অক্টোবর বিকেল ৩টা পর্যন্ত তিস্তায় পানি বৃদ্ধির পরিমাণ ৬৯ সেন্টিমিটার। বিকেল ৩টার পর থেকে তা বিপৎসীমা অতিক্রম করে। এ সময়ে উজানে ভারতের দোমহনীতে ১৫৮ এবং গজলডোবায় ২২০ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে তিস্তার দৌমুহনীতে ৫৫ এবং গজলডোবায় ১১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও ভুটানের ওয়াংচু নদীর পানি তালা ড্যামের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ধরলা ও দুধকুমার নদীর উজানে ভারতে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছে। ফলে সোমবার সকাল থেকেই ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানিও বাংলাদেশে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া শুরু করবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব জানান, উজানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমে ভারী ও অতি ভারী বৃষ্টি এবং বাংলাদেশে বৃষ্টির কারণে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি আরো জানান, ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টের সবকটি জলকপাট খুলে দেয়া হয়েছে। তবুও সামলানো যাচ্ছে না পানি। এরই মধ্যে ফ্লাড বাইপাসের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ফ্ল্যাট বাইপাসটি কেটে দেয়া হতে পারে। এছাড়াও মাইকিং করিয়ে তিস্তা অববাহিকার মানুষদের নিরাপদে আশ্রয়ে চলে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে তিস্তা অববাহিকায় অনেক বাসাবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব স্থান কোমর পানি তলিয়ে গেছে। নিরাপদ আশ্রয় নেয়ার জন্য তৈরি করে রাখা হয়েছে বোর্ড।
‘এমন পরিস্থিতিতে তিস্তার পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ফলে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম জেলার এসব নদীসংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে।
আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ের ২৬১ মিলিমিটার, কোচবিহারে ১৯০ মিলিমিটার জলপাইগুড়িতে ১৭২ মিলিমিটার, পশ্চিমবঙ্গে ১৩৪ মিলিমিটার, অরুণাচলে ৮৯ মিলিমিটার এবং গ্যাংটক সিকিমে ৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পঞ্চগড়ে ১১৮, ডালিয়ায় ৮৫, কুড়িগ্রামের পাটেশ্বরীতে ৭৬, রংপুরে ২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মোস্তাফিজার রহমান জানান, আগামী ২৪ ঘণ্টায় উজানে ভারতসহ রংপুর বিভাগে ভারীসহ অতি ভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিপৎসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় মধ্যরাত থেকেই তিস্তা অববাহিকার ১৫২ কিলোমিটার এবং ধরলা ও ব্রক্ষপুত্র এলাকার ৩৬০ কিলোমিটার এলাকার চরাঞ্চল ছাড়াও নদী-তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার হেক্টর জমির আমনের আবাদ, সবজির আবাদ এখন অথৈ পানির নিচে। হাজার হাজার পুকুর তলিয়ে লাখ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়েছে যাতায়াত।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ ও সরেজমিনে পাওয়া তথ্যেমতে, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নীলফামারীর ডোমার, ডালিয়া, জলঢাকা, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, লালমনিরহাটের সদর, আদিতমারী, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ি, ভুরুঙ্গামারী, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল এখন হাঁটু পানির নিচে।
অববাহিকা থেকে পাওয়া তথ্যমতে, রোববার মধ্যরাতের পর থেকে তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বাড়িঘরে পানি উঠে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে মানুষজন। চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলগুলো থেকে মানুষজন বাড়িঘর ছেড়ে গবাদিপশুসহ প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিচ্ছেন।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, পানিবন্দী পরিবারগুলো ছোট শিশু, বৃদ্ধ ও গরু, ছাগল, হাস-মুরগী নিয়ে মারাত্মক বিপাকে পড়েছেন। আত্মীয়-স্বজনদের দেয়া ও শুকনো খাবারই একমাত্র ভরসা পানিবন্দীদের। বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। টয়লেট নিয়ে সমস্যা হচ্ছে।
গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদুল হাসান মৃধা জানিয়েছেন, তিস্তার নিমানঞ্চল ও চরাঞ্চলগুলো থেকে লোকজনকে এরই মধ্যে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বাসাবাড়িতে পানি ঢুকেছে। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের লোকজন পানিবন্দী মানুষের পাশে রয়েছে।
রংপুরের ডিসি মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল জানান, ‘আমার তিনটি উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের চরাঞ্চল ও নিমাঞ্চলে পানি ঢুকেছে। সে কারণে তিনটি উপজেলা প্রশাসনকেই সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারা রাতেই মাঠে কাজ শুরু করেছেন। খাবার ও আশ্রয় নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।’
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরানুজ্জামান বলেন, ‘তিস্তার পানি বেড়ে একটি বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছিল। সেটি মেরামত করা হয়েছে। তবে পানি বেড়ে অনেকের ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী মানুষদের নিরাপদ স্থানে নেয়া এবং শুকনো খাবার বিতরণের কাজ চলছে।’
লালমনিরহাটের ডিসি এইচ এম রকিব হায়দার জানান, ‘আকস্মিক তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে পাঁচ উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের সর্বাত্মক সহযোগিতা, সতর্ক ও খোঁজখবর রাখার জন্য বলা হয়েছে। চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলগুলোতে ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বন্যার পানি আরো বৃদ্ধি ও স্থায়ী হলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সাফিয়া রহমান জানান, ‘প্রতিবছর দফায় দফায় বন্যায় বিশাল আকারের ক্ষয়ক্ষতি হয় তিস্তা অপবাহিকায়। এজন্য আমরা চাই নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগেই মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু করা হোক। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া তিস্তা অববাহিকার মানুষের চরম ভোগান্তি কখনো দূর হবে না।’
তিস্তা নদীর রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, ‘তিস্তা পারের মানুষের এই কান্না আমরা আর দেখতে চাই না। এজন্য আমরা ধারাবাহিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। আমরা মনে করি তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু না হলে এবং তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন না হলে এ অঞ্চলের দুই কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মধ্যে থাকবে। যেমন মধ্যরাত থেকে তিস্তার পানি ফুলে অববাহিকার প্রত্যেকটি মানুষের বাড়িতে পানি উঠেছে। আবাদি জমি তলিয়ে গেছে। রাস্তাঘাটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এটার স্থায়ী সমাধানে নভেম্বরের মধ্যেই তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’
রংপুর বিভাগীয় কমিশনার শহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘তিস্তা নদীতে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাঁচ জেলার জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন মাইকিং করে এলাকাবাসীকে সতর্ক করছেন। তাদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে।’