
যেসব দেশ ১৯৮১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছে সেগুলোর কর্মসংস্থানের ওপর কী প্রভাব পড়েছে এ নিয়ে গবেষণা করেছেন দুই গ্রিক অর্থনীতিবিদ মাইকেল ক্লেটসস ও আন্দ্রেয়াস সিন্টোস। ওই গবেষণায় দেখা যায়, কঠোর শর্তযুক্ত এ ঋণ গ্রহণকারী দেশগুলোয় বেকারত্ব বেড়েছে, কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে এবং শ্রমবাজারে অনিশ্চয়তা গভীরতর হয়েছে। আন্তর্জাতিক আর্থিক পরিসংখ্যান ও ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটরসের তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষক দুজন দেখিয়েছেন, আইএমএফের শর্তযুক্ত ঋণ কর্মসূচিতে অংশ নেয়া দেশগুলো বাজেট ঘাটতি কমানো, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ, শ্রমবাজার উদারীকরণ ও সরকারি ব্যয় সংকোচনের মতো শর্ত বাস্তবায়নের ফলে লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ‘দি ইফেক্টস অব আইএমএফ কন্ডিশনাল প্রোগ্রাম অন দি আনএমপ্লয়মেন্ট রেট’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রকাশ করে ইউরোপিয়ান জার্নাল অব পলিটিক্যাল ইকোনমি।
কভিড-পরবর্তী সময়ে তীব্র ডলার সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাতে অস্থিরতাসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতার প্রভাবে চাপে পড়েছিল ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার। নানামুখী সে সংকট উত্তরণে ২০২২ সালের শেষের দিকে আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল তৎকালীন সরকারকে। ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির জন্য মেনে নিতে হয়েছিল অর্ধশতাধিক শর্ত। দাতা সংস্থাটির সেসব শর্ত পূরণ করতে গিয়ে দেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায়। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ সংকুচিত হয়ে বেকারত্ব বাড়তে থাকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৩ সালের শুরুতে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচিতে যুক্ত হয় তৎকালীন সরকার। ওই সময় থেকে সংস্থাটির চাপিয়ে দেয়া নানা শর্ত পূরণ শুরু হয়। ভর্তুকি প্রত্যাহারের কথা বলে বাড়ানো হয় জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম। একই বছরের জুনে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশের সীমা তুলে নেয়া হয়। বাড়ানো হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার। এর প্রভাবে বাড়তে শুরু করে ব্যাংক ঋণের সুদ। বিপরীতে কমতে থাকে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ। কৃচ্ছ্রসাধন শুরু হয় সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রেও। কমিয়ে আনা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার। অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা বলে নেয়া এসব উদ্যোগের প্রভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়ে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার বাড়তে শুরু করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছে ‘স্ট্যাটিস্টা’। জার্মানিভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত সরবরাহকারী এ প্রতিষ্ঠানের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। বৈশ্বিক মহামারী কভিডের প্রভাবে ২০২০ সালে বেকারত্বের এ হার বেড়ে ১৩ দশমিক ২৯ শতাংশে উন্নীত হয়। তবে ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ধারাবাহিকভাবে কমে আসে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে বেকারত্বের হার আবার বাড়তে শুরু করে। ২০২৩ সালে বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৯ শতাংশ থাকলেও ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এ পরিসংখ্যানে স্ট্যাটিস্টা ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের তরুণ হিসেবে বিবেচনা করেছে।
আইএমএফের ঋণের প্রভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বণ্টনে নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায় পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকাকেও একই অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়েছিল। দাতা সংস্থাটির ঋণের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে বাজেট কমে যাওয়া, কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়া এবং দারিদ্র্য ও আয়বৈষম্য বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা গেছে আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায়ও।
কভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির প্রভাব নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’। ‘ব্যান্ডেজ অন আ বুলেট উন্ড’ বা ‘গুলির ক্ষতের ওপর ব্যান্ডেজ’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে দেখানো হয়, আইএমএফের ঋণ কর্মসূচিতে গিয়ে ৩৩টি দেশ সরকারি খরচ কমানো, নিয়োগ বন্ধ করা ও বেতন কাটা বা স্থগিত রাখার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে ওইসব দেশের কর্মসংস্থান ও সামাজিক সেবায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
সরকার আইএমএফকে খুশি করতে গিয়ে সবকিছু বিসর্জন দিচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ)। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছে যখনই আমরা কোনো দাবি নিয়ে যাচ্ছি, তখনই বলা হচ্ছে এটি করা যাবে না, আইএমএফের নিষেধ আছে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে করপোরেট ট্যাক্স কমানোর দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু সরকার বলেছে, এটি কমানো যাবে না, কারণ আইএমএফ নিষেধ করেছে। সরকার দুঃসময়ে এসে রফতানি ভর্তুকি কমিয়ে দিচ্ছে, আমরা প্রতিবাদ করলে বলছে, আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে ভর্তুকি কমানো হচ্ছে। খেলাপি ঋণের মেয়াদ গণনা তিন মাসের মধ্যে নামিয়ে আনা হয়েছে, এতে ব্যবসায়ীরা গণহারে খেলাপি হয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রেও আইএমএফের দোহাই দেয়া হচ্ছে। আইএমএফের শর্ত মেনে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানো হয়েছে। আবার ইডিএফের আকার ও ঋণসীমা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব ক্ষেত্রেও বলা হচ্ছে আইএমফের শর্তের কথা। সবকিছুই যদি আইএমএফের কথা অনুযায়ী চলে, তাহলে সরকারের কাজ কী।’
পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে এ ব্যবসায়ী নেতা আরো বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথ পুরোপুরি থমকে গেছে। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকারত্ব বাড়ছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি হচ্ছে না। এখনকার অর্থনৈতিক স্থবিরতার বিরূপ প্রভাব দৃশ্যমান হবে দুই-তিন বছর পর। তখন অর্থনীতিকে টেনে তুলবে কে? আইএমএফ এসে কোনো প্রতিষ্ঠান বাঁচাবে না। চলতি মূলধনের অভাব কিংবা ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ার প্রভাবে যে কারখানা এখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, দুই বছর পর সে প্রতিষ্ঠানকে টাকা দেয়া হলেও সেটি কোনো কাজে লাগবে না।’
সরকারের নিয়োগ, উন্নয়ন প্রকল্প ও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের মাধ্যমে মূলত দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। যদিও এ মুহূর্তে দেশে নতুন বিনিয়োগ কার্যত থমকে গেছে। শিল্প ও ব্যবসা খাতে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ না আসায় সামগ্রিক অর্থনীতিও এখন আনেকটাই স্থবির। রুটিন কর্মকাণ্ডের বাইরে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে যাচ্ছে না সরকার। নতুন শিল্প স্থাপন কিংবা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেই বেসরকারি খাতেও। এ পরিস্থিতিতে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ঋণের চাহিদা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। আবার পুঁজিবাজারেও কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের জুনে দেশের বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ইতিহাসের সর্বনিম্নে নেমে এসেছিল। আর জুলাইয়ে এসে প্রবৃদ্ধি নয়, বরং বেসরকারি খাতের ঋণ স্থিতি ঋণাত্মক ধারায় চলে গেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ মাস তথা জুনে বেসরকারি খাতে ঋণ স্থিতি ছিল ১৭ লাখ ৪৭ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এ ঋণ স্থিতি ১৭ লাখ ৪২ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। সে হিসাবে অর্থবছরের প্রথম মাসে ঋণ প্রবৃদ্ধি না হয়ে বরং ঋণাত্মক ধারায় নেমে গেছে। এক্ষেত্রে ঋণের স্থিতি কমেছে ৫ হাজার ৫৩ কোটি টাকা।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তিন অর্থবছর ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু অর্থবছর শেষে সে লক্ষ্যের ধারেকাছেও যেতে পারেনি দেশের ব্যাংক খাত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
বেসরকারি খাতের বিরাজমান ঋণ প্রবৃদ্ধিকে ঐতিহাসিকভাবে সর্বনিম্ন বলে আখ্যায়িত করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। সরকারের এ বিভাগের সেপ্টেম্বরের ‘ইকোনমিক আপডেট অ্যান্ড আউটলুক’-এ বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচে থাকা এ প্রবৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহ, উচ্চ সুদহার, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ব্যাংকগুলোর সতর্ক ঋণনীতির প্রতিফলন।
জিইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, এ মুহূর্তে অর্থনীতির অন্যতম দুর্বল দিক হলো উন্নয়ন ব্যয়ের ধীরগতি। নতুন অর্থবছর শুরুর প্রথম দুই মাস (জুলাই-আগস্ট) এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ থেকেও কম। আগস্টে বাস্তবায়ন সামান্য উন্নতি হয়েছে, তবে সামগ্রিক অগ্রগতি কাঙ্ক্ষিত নয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে কাঠামোগত সমস্যাগুলো এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে রাজস্ব খাতেও লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতা দেখা যাচ্ছে। আগস্টে রাজস্ব আয় হয়েছে ২৭ হাজার ১৬২ কোটি টাকা, যেখানে লক্ষ্য ছিল ৩০ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসেই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকায়। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আয় ১৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেড়েছে, যা কিছুটা আশার সঞ্চার করলেও লক্ষ্য পূরণে দীর্ঘ পথ বাকি বলে জিইডির প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুনের ভাষ্য হলো, ‘এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে অনেক দেশেই আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির ফলাফল ভালো হয়নি। তবে এটিও দেখতে হবে, কখন একটি দেশ আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। আমরা দেখছি, কোনো দেশ তখনই আইএমএফের ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়, যখন সে দেশের সামনে কোনো বিকল্প থাকে না।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক পদে দায়িত্বরত এ অর্থনীতিবিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইএমএফ ঋণের জন্য অনেক শর্ত দেয়। কিন্তু সেসব শর্ত নিয়ে দরকষাকষিরও সুযোগ থাকে। এ দরকষাকষির সাফল্য নির্ভর করে সে দেশের সরকারের সক্ষমতার ওপর। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর হাতে দরকষাকষির খুব বেশি সুযোগ থাকে না। তবে অতীতে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার পর বাংলাদেশ শর্ত পূরণ না করে কর্মসূচি থেকে বের হয়ে আসার নজিরও আছে। কিন্তু এখন কেন সব শর্ত পূরণ করতে হচ্ছে। আইএমএফের কাছ থেকে এ ঋণ বাংলাদেশ না নিয়ে যদি ভারত নিত, তাহলে হয়তো শর্তগুলো এমন হতো না।’
ফাহমিদা খাতুন আরো বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও ঋণের সুদহার বাড়াতে হতো। এটি কেবল আইএমএফের শর্ত পরিপালন হিসেবে দেখলে হবে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবিরতা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ার জন্য কেবল ঋণের উচ্চ সুদহার দায়ী নয়। উচ্চ সুদহার কস্ট অব ডুয়িং বিজনেসের কেবল একটি উপাদান। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ঘুস, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, বন্দরের অব্যবস্থাপনা, দক্ষ জনশক্তির অভাব, জ্বালানি ও বিদ্যুতের দামসহ বহুকিছু এক্ষেত্রে জড়িত। এসব সমস্যার সমাধান না করে বিনিয়োগ বাড়ানো ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি খুবই কঠিন।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যার ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী বেকার যুবকদের সংখ্যা ছিল ২১ লাখ ৫০ হাজার। ২০২৩ সালে দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৬০ হাজার। এর মধ্যে বেকার যুবকদের সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ ৪০ হাজার। সর্বশেষ ২০২৪ সালে দেশের বেকার জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ২০ হাজারে। এর মধ্যে বেকার যুবকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ লাখে।
জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন গবেষক কাভিশ হাজারনাভিস, ধ্রুব মহাজন ও হিউনউ রোহের ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণ কর্মসূচি কতটা সফল’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রবন্ধে ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা হয়। মূলত কোনো দেশের বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, প্রকৃত জিডিপি, রফতানি ও সরকারি ঋণের অনুপাতের ওপর আইএমএফের ঋণ কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে এমন ১৫৫টি দেশ এবং ঋণ নেয়নি কিন্তু একই ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে ছিল এমন ২৭টি দেশের তুলনা করা হয়েছে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ঋণ গ্রহণকারী দেশগুলোয় বেকারত্ব ৫ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে, যেখানে ঋণ না নেয়া দেশগুলোয় বেকারত্ব ৭ শতাংশ কমেছে। আইএমএফের ঋণপ্রাপ্ত দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতি গড়ে ৭০ শতাংশ কমেছে, যা একমাত্র ইতিবাচক দিক। আইএমএফের ঋণ নেয়া দেশগুলোয় জিডিপি ৫৮ শতাংশ বাড়লেও ঋণ না দেশগুলোয় তা বেড়েছে ৭৬ শতাংশ। আইএমএফের ঋণ নেয়নি এমন দেশগুলোয় রফতানি ৯৯ শতাংশ বাড়লেও যেসব দেশ ঋণ নিয়েছে সেগুলোর রফতানি বেড়েছে ৭২ শতাংশ। আইএমএফের ঋণ নেয়া দেশগুলোয় সরকারের ঋণের পরিমাণ ১ শতাংশ বাড়লেও ঋণ না নেয়া দেশগুলোয় ঋণ কমেছে ১৬ শতাংশ।
তবে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির কারণে দেশে বেকারত্ব বেড়েছে বলে মনে করছেন না বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০১৬-১৭ সালের পর থেকেই এমনটি দেখা যাচ্ছে। এটিকে আমরা মধ্যম আয়ের ফাঁদ হিসেবে অভিহিত করতে পারি। সুদহার দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বেঁধে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সে সময়েও তো বিনিয়োগ বাড়তে দেখা যায়নি, যা কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করবে। তাই সুদহার বাড়লেই যে বিনিয়োগ আসবে না, তা নয়। বরং ব্যবসা সহজীকরণ সূচক, কাঠামোগত সংস্কারের মতো বিষয়গুলো বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। বিনিয়োগকারীরা যদি দেখে যে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ বিদ্যমান, তারা এখানে ব্যবসা করে আকর্ষণীয় রিটার্ন পাবে তাহলেই তারা নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।’
প্রথমে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে বর্ধিত ঋণ সহায়তা বা বর্ধিত তহবিল (ইসিএফ অ্যান্ড ইএফএফ) থেকে ৩৩০ কোটি ডলার এবং রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় ১৪০ কোটি ডলার দেয়ার কথা ছিল। তবে গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ঋণ কর্মসূচির আওতায় আরো বাড়তি ঋণ দেয়ার অনুরোধ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফের পর্ষদ বাংলাদেশের জন্য ইসিএফ অ্যান্ড ইএফএফের আওতায় মোট ৪১০ কোটি ডলার অনুমোদন করে। এর সঙ্গে আরএসএফের আওতায় ১৪০ কোটি ডলার মিলিয়ে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৫০ কোটি ডলারে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ঋণ কর্মসূচির আকার বেড়েছে প্রায় ৮০ কোটি ডলার। প্রথমে ২০২৬ সালের মে পর্যন্ত এ ঋণ কর্মসূচির মেয়াদ নির্ধারিত ছিল। তবে ঋণের আকার বাড়ার কারণে ইসিএফ অ্যান্ড ইএফএফের অধীনে এর মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইএমএফের পর্ষদ। এ বছরের জুনে ঋণ কর্মসূচির আওতায় চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি বাবদ বাংলাদেশের জন্য ১৩৩ কোটি ডলার ছাড় করে আইএমএফের পর্ষদ। ষষ্ঠ কিস্তির অর্থছাড়ের আগে শর্ত ও সংস্কার বাস্তবায়নের বিষয়টি মূল্যায়ন করতে ২৯ অক্টোবর সংস্থাটির একটি মিশন বাংলাদেশে আসছে।