
প্রচারের ঘাটতি ও সচেতনতার অভাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সহজ ও স্বল্প খরচে বিচার প্রাপ্তির সুযোগ করে দিতে প্রতিষ্ঠিত গ্রাম আদালতে কাক্সিক্ষত সুফল মিলছে না। শুধু না জানার কারণে স্থানীয় মানুষ বিরোধে জড়ালে ইউনিয়ন পরিষদে থাকা এই বিকল্প বিচারব্যবস্থার বদলে গ্রাম্য সালিশ বা থানা পুলিশের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এর ফলে গ্রাম্য সালিশে যেমন কাক্সিক্ষত ন্যায়বিচার বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা থাকছে, অন্যদিকে থানা পুলিশ করলে বাড়ছে মামলাজট। একই সঙ্গে বাড়ছে ভোগান্তিও।
জানা গেছে, দেশে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে গ্রাম আদালত গঠনের পর থেকে মামলার নিষ্পত্তির হার ধীরে ধীরে বাড়লেও তা এখনো প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম। অনেক ইউনিয়নে এখনো আদালত কার্যক্রম নিয়মিত নয়। সংশ্লিষ্টরা বলেন, গ্রাম আদালতের উদ্দেশ্যই ছিল মানুষকে আদালতের জটিলতা থেকে মুক্তি দিয়ে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রচারের অভাবে সাধারণ মানুষ এ সুবিধা সম্পর্কে জানেন না।
আইনজ্ঞরা বলছেন, গ্রাম আদালতের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, প্রশিক্ষণ ও প্রচার বৃদ্ধি করলে এ ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। এতে শুধু গ্রামের মানুষই উপকৃত হবেন না, পাশাপাশি দেশের আদালত ব্যবস্থার চাপও কমবে। তারা বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা যথাযথ প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় অনেক জায়গায় আদালত কার্যকরভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। আবার কোথাও বিচারপ্রার্থীরা প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানেন না বলে মামলাই হয় না।
গ্রাম আদালতকে আরও কার্যকর করতে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনও বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছে তাদের প্রতিবেদনে। এই সুপারিশে আইনগত সংস্কারের কথা বলা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৭৬ সালে গ্রাম আদালত অধ্যাদেশের মাধ্যমে দেশে গ্রাম আদালতের প্রচলন হয়। এরপর বেশ কয়েকবার সংশোধন হয়েছে এই আইন। ২০০৬ সালে গ্রাম আদালত আইন পাসের পর গ্রাম আদালত ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, ইউএনডিপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ শুরু করে। বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ পাইলট প্রকল্প ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ৩৫১টি ইউনিয়নে প্রথম পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ১ হাজার ৮০টি ইউনিয়নে বাস্তবায়িত হয় ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত। বর্তমানে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ তৃতীয় পর্যায়ের প্রকল্প চলছে। চলবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত। এই প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে পার্বত্য তিন জেলা বাদে দেশের ৪ হাজার ৪৫৩টি ইউনিয়নে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণের কাজ চলমান রয়েছে।
জানা গেছে, গ্রাম আদালতে ফৌজদারি মামলা করতে ১০ টাকা এবং দেওয়ানি মামলা করতে ২০ টাকা আবেদন ফি দিতে হয়। আর আদালত থেকে কোনো মামলা পাঠানো হলে তার জন্য কোনো ফি নেই। আইন অনুযায়ী, এই আদালতে অভিযোগ করতে হয় ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে। আর কোনো অভিযোগ দাখিল হওয়ার সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করতে হয়। আইনে এই আদালত থেকে সরাসরি শাস্তির বিধান না থাকলেও সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারে। এই আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ পক্ষ এখতিয়ার সম্পন্ন সহকারী জজ আদালতে আপিল করতে পারেন। জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গ্রাম আদালত সস্পর্কে এখনো দেশের সাধারণ মানুষ খুব বেশি জানে না। এখনো তারা এই আদালতকে গ্রাম্য সালিশের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। তাই তাদের ভুল ভাঙতে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে এই আদালত সম্পর্কে গ্রামের মানুষদের আগ্রহ তৈরিতে প্রচার প্রচারণার ব্যবস্থাও রাখতে হবে। তিনি বলেন, গ্রাম আদালত পুরোপুরি কার্যকর করা গেলে শুধু গ্রামের মানুষই উপকৃত হবেন না, পাশাপাশি দেশের আদালত ব্যবস্থার চাপও কমবে। একই সঙ্গে এই আদালতে যারা বিচারিক প্যানেলের সদস্য থাকবেন তাদেরও যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই সুফল মিলবে।
যা আছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে : বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গ্রাম আদালত পুরোপুরি কার্যকর করতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুপারিশ করেছিল। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, গ্রাম আদালতের বিদ্যমান কাঠামোর অতিরিক্ত হিসেবে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের বিচক্ষণ, অভিজ্ঞ এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য শিক্ষিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা প্যানেল গঠন করতে হবে। আদালত গঠনের ক্ষেত্রে অসুবিধা সৃষ্টি হলে চেয়ারম্যান কোনো উপদেষ্টাকে সদস্য করতে পারবেন। সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, এজলাস কক্ষের কর্ম পরিবেশসহ সব কার্যক্রমে বিচারিক পরিবেশ, বিচারিক মূল্যবোধ এবং বিচারিক পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলন নিশ্চিত করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়সূচি ধার্য করতে হবে। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের সভাপতিত্বে একটি তদারকি কমিটি গঠন করতে হবে। যেখানে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও থাকবেন। গ্রাম আদালতের বিচারিক কার্যক্রম স্বচ্ছ, কার্যকর ও গতিশীল করার জন্য প্রয়োজনীয় সার্কুলার, নির্দেশনা ইত্যাদি জারির উদ্যোগ গ্রহণ করা। গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ এর ৬(গ)(২) ধারায় উল্লিখিত ৯০ দিনে নিষ্পত্তির সময়সীমা কমানো। আদালত বা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলা গ্রহণকালে প্রাথমিক যাচাইবাছাইয়ে বিরোধটি গ্রাম আদালতে বিচার্য মনে হলে সেখানে পাঠানোর জন্য আইন সংশোধন। আদালতের কার্যক্রম চলাকালে নিরাপত্তার জন্য গ্রাম পুলিশের দলকে নিয়োজিত করা বা পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা।