
কানাডায় বাংলাদেশিদের ‘বেগমপাড়া’ প্রথম আলোচনায় আসে ২০২০ সালের পর। যে বছর যাবতীয় ব্যস্ততা করোনাভাইরাসকেন্দ্রিক থাকলেও বছর শেষে এসে দেশে তুমুল আলোচনার জন্ম দেয় কানাডায় বাংলাদেশিদের বেগমপাড়া। দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া বহু সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ তাদের স্ত্রী-সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছেন কানাডায়। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় কানাডা এবং বাংলাদেশে।
২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন কানাডার বেগমপাড়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘কানাডায় খবর নিয়েছি, প্রাথমিকভাবে কিছু সত্যতা পেয়েছি। মনে করছিলাম রাজনীতিবিদের সংখ্যা বেশি হবে। কিন্তু দেখা গেল রাজনীতিবিদ চারজন। সরকারি কর্মচারীর সংখ্যাই বেশি। এ ছাড়া কিছু ব্যবসায়ীও আছেন। বিদেশে যদি কেউ বৈধভাবে টাকা নেন, তাহলে কোনো আপত্তি নেই। তবে অবৈধভাবে পাচার করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এর পরই আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে বেগমপাড়া। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সরকারের কাছে ২৮ জনের তালিকা চায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই বছরের ২৩ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক শেষে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের বাইরে অর্থ পাচারে জড়িতদের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য তদন্ত সংস্থা কাজ করছে।’
এ পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের যাবতীয় তথ্য চান হাই কোর্ট। ফলে ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর হাই কোর্টে দুদক, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অর্থ পাচারের বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। এ সময় শতাধিক ব্যক্তির নামে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচারের তথ্য দেয় দুদক। তবে এতে সন্তুষ্ট হননি আদালত। কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে যারা অবৈধ গাড়ি-বাড়ি তৈরি করেছেন, তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পরের বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন হাই কোর্ট। এর পরই পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়। অদৃশ্য ইশারায় রিট আবেদনটি হাই কোর্টের তালিকার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ যারা কানাডায় অর্থ পাচার করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তারাই ছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে। ফলে এ আলোচনা বন্ধ করা হয় তৎকালীন সরকারের চাপেই।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে ২০২০ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি ২৮ জনের তালিকাটি এসেছে। এ তালিকায় বেশির ভাগ নামই সাবেক আমলাদের। এদের মধ্যে রয়েছেন ড. আহমদ কায়কাউস, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, কানাডার মন্ট্রিল ও টরন্টোয় চারটি বাড়ির মালিক। আবু আলম শহীদ খান, ’৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকার সচিব হিসেবে অবসরে যান। (বর্তমানে কারান্তরিন)। টরন্টোয় তার বাড়ি রয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, ’৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা। টরন্টোয় তার তিনটি ফ্ল্যাট আছে। নজিবুর রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, যিনি এনবিআরের চেয়ারম্যানও ছিলেন। (বর্তমানে কারাবন্দি) মিসিসাগায় রয়েছে তার বিলাসবহুল দুটি বাড়ি।
আলাউদ্দিন নাসিম চৌধুরী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার (১৯৮৬ ব্যাচের কর্মকর্তা), কানাডায় রয়েছে তার বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। এম হেলাল উদ্দিন, সাবেক সচিব, টরন্টো ও মন্ট্রিলে রয়েছে তার পাঁচটি ফ্ল্যাট। ড. ইকবাল মাহমুদ, দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, কানাডায় রয়েছে তার তিনটি বাড়ি। মহিবুল হক, সাবেক বিমান সচিব, কানাডায় রয়েছে তার তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট। ফজলে কবির, সাবেক সচিব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, মন্ট্রিলে রয়েছে তার দুটি ফ্ল্যাট।
আবদুর রউফ তালুকদার, সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, টরন্টোয় রয়েছে তার পাঁচটি বাড়ি এবং ফ্ল্যাট।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সাবেক সচিব, মন্ট্রিলে রয়েছে তিনটি বাড়ি। জাহাংগীর আলম, সাবেক সচিব, কানাডায় দুটি বাড়ি। এম. নিয়াজ উদ্দিন, সাবেক সচিব, দুটি বাড়ি এবং একটি খামারবাড়ি।
প্রশান্ত কুমার হালদার, সাবেক সচিব, তিনটি ফ্ল্যাটের মালিক। নাফিস সরাফত, চারটি ফ্ল্যাট এবং বিনিয়োগ (শেয়ার)। শহীদ ইসলাম পাপুল, তিনটি বাড়ি ও বিনিয়োগ। তানভীর ইমাম, সাবেক এমপি, দুটি ফ্ল্যাট। মতিউর রহমান, এনবিআর কর্মকর্তা, তিনটি বাড়ি। নাইমুল ইসলাম খান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব, একটি ফ্ল্যাট। নজরুল ইসলাম মজুমদার, চেয়ারম্যান, নাসা গ্রুপ, চারটি বাড়ি এবং বিনিয়োগ। শামীম ওসমান, একটি বাড়ি। বেনজীর আহমেদ, পুলিশের সাবেক আইজি, মেয়ের নামে দুটি বাড়ি। বিচারপতি এস কে সিনহা, সাবেক প্রধান বিচারপতি, মেয়ের নামে একটি ফ্ল্যাট।
শাহরিয়ার আলম, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, তিনটি বাড়ি ও বিনিয়োগ। এ ছাড়া কয়েকজন ব্যবসায়ীও রয়েছেন এ তালিকায়। এদের পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য কানাডায় থাকেন।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে কানাডায় সবচেয়ে আলোচিত হলেন একজন বহুলবিতর্কিত ব্যবসায়ী। তার ও তার পরিবারের সদস্যদের কানাডায় রয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ। দেশের যেসব উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদের স্ত্রী-সন্তানরা কানাডার টরন্টো, মন্ট্রিল, অটোয়া শহরে অভিবাসী হয়েছেন; তাদের সবাই সেখানে রাজকীয় জীবনযাপন করেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভাষ্য, কানাডার বিভিন্ন শহরে যেসব বাংলাদেশি বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনেছেন তাদের অধিকাংশই অবৈধভাবে অর্থ পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের পতনের পর এসব লুটেরা অর্থ পাচারকারীর উপস্থিতি কানাডায় বেড়েছে। আগে যারা বছরে এক-দুইবার কানাডায় এসে অবসর কাটিয়ে চলে যেতেন; তারা এখন মাসের পর মাস কানাডাতেই থাকছেন। শুধু তাই নয়, ৫ আগস্টের পর নতুন আরও শতাধিক বাংলাদেশি কানাডায় আশ্রয় নিয়েছেন। কানাডা সরকারের তথ্যমতে ৫ আগস্টের পর থেকে গত জুলাই পর্যন্ত ২৩১ জন বাংলাদেশি কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। এর মধ্যে রাজনীতিবিদ ছাড়াও আছেন আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা এবং কূটনীতিক। কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশিরা বলছেন, এদের বৈধ আয়ের কোনো উৎস না থাকলেও এরা এখানে রাজার হলে চলছেন। এ নিয়ে কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া।