
এবারের দুর্গাপূজায় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের বাড়াবাড়ি রকমের উপস্থিতি ও কথাবার্তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় চলছে। ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দল জামায়াত এবং জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিএনপি নেতাদের বাড়াবাড়ি রকমের ভক্তি-শ্রদ্ধা নিয়ে বিতর্ক চলছে। ভারতকে খুশি করা ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কিছু ভোটের জন্য এমন কা- কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না দেশের তৌহিদি জনতা। দেশের আলেম-ওলামারা বিশেষ করে জামায়াত নেতাদের কা-ের তীব্র প্রতিবাদ করছেন। সুনামগঞ্জের জামায়াতের এক আইনজীবী নেতার ‘পূজা আর রোজা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ’ বক্তব্য এবং খুলনার এক নেতার ‘আল্লাহ পূজায় আসার তৌফিক দান করেছে’, জামায়াত নেতার ‘গিতা পাঠ’ বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা চলছে।
এবারের দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু ভোট টানতে যেন হিন্দুতোষণের প্রতিযোগিতায় নামে জামায়াতের অনেক নেতা। ইসলামের নাম ভাঙিয়ে রাজনীতি করা দলটির কোনো নেতা পবিত্র আজানের সাথে হিন্দুদের উলুধ্বনির তুলনা করেছেন। বিএনপির নেতারাও কম যাননি। লক্ষ্মীপুরে বিএনপির এক নেতা মা দুর্গার শক্তি নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়েও বিতর্ক চলছে।
ক্ষমতার লোভে শিরকের সাথে আপস করা জামায়াতের এসব নেতার বিতর্কিত মন্তব্যে ব্যাপক ক্ষোভ, বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক মাধ্যমে। এ নিয়ে ঘরে-বাইরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে জামায়াত। ফলে পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারতকে খুশি করতে এবং দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটা পেতে দলটির ‘অসাম্প্রদায়িক কার্ড’ খেলার এই কৌশল বুমেরাং হয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এবারের দুর্গাপূজায় হিন্দু কার্ড খেলায় পিছিয়ে ছিল না বিএনপিও। দলটির অনেক নেতাকেও অতি উৎসাহী হয়ে বেফাঁস মন্তব্য করতে দেখা গেছে। যা ক্ষুব্ধ করেছে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াত ক্ষমতার লোভে এ বছর দুর্গাপূজায় ম-পে গেছে। সেখানে গিয়ে হিন্দু ভোটারদের খুশি করতে উল্টাপাল্টা বক্তব্য দিয়েছে। হিকমার (কৌশল) কথা বলে মূলত ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে জামায়াত নির্লজ্জভাবে ভারত ও হিন্দুতোষণ শুরু করেছে। দলটির নেতারা হিন্দু ভোট টানতে গিয়ে ইসলামের সবচেয়ে মারাত্মক পাপÑ শিরকের সাথে আপস করে নির্দ্বিধায় ঈমান বিসর্জন দিয়ে দিলেন! সামনে ভোট, এ জন্য ফতোয়া ঘুরিয়ে দিলেন? অথচ সারা জীবন দলটি বলেছে, হিন্দুদের পূজায় যাওয়া গুনাহের কাজ। কেউ লিখেছেন, অনেকের কাছে ঈমানের চেয়ে ভোটের দাম বেশি। হায় আফসোস!
জামায়াত ও বিএনপি নেতাদের এই কা-ে দেশের ইসলামী স্কলাররা বলছেন, ইসলামে ঈমান ও শিরক প্রশ্নে কোনো হিকমাহ চলে না। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, মানুষের কাছে ভিক্ষা চেয়ে ক্ষমতাধর হওয়া যায় না, আল্লাহর দরবারে ভিক্ষা করতে হয়। যাদের ভোট ভিক্ষা করতে গিয়ে লোকজন শিরকে হাবুডুবু খাচ্ছে, তারা কখনোই তাদের বলয় ও অ্যাজেন্ডার বাইরে যাবে না। মধ্যখানে ভিক্ষুকদের দুনিয়াও যায়, আখিরাতও যায়।
এ বছর বাংলাদেশে দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের হিন্দু সম্প্রদায়কে দেয়া শুভেচ্ছা বার্তা নিয়ে প্রথম বিতর্ক শুরু হয়। এ নিয়ে দলটির অভ্যন্তরে ও বাইরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এই ঘটনাকে অনেকেই জামায়াতের পক্ষ থেকে ‘অসাম্প্রদায়িক কার্ড’ খেলার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলটির নিজস্ব কর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে মতবিরোধের কারণে এটি এক প্রকার ‘বুমেরাং’ হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
জামায়াতের ছাত্র সংগঠন-ইসলামী ছাত্রশিবিরের ফেনী জেলা শাখার সভাপতি আবু হানিফ হেলাল এই শুভেচ্ছার বিরোধিতা করে একটি ফেসবুক পোস্ট দেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, রাজনৈতিক নেতারা রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে পারেন, তবে তা যেন তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়। তিনি পরামর্শ দেন, নেতারা উৎসবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানাতে পারতেন; কিন্তু সরাসরি শুভেচ্ছা জানানো উচিত হয়নি। তিনি ‘অন্ধ আনুগত্য’ অনুসরণ করেন না জানিয়ে এই দ্বিমত প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশে এর আগে বিভিন্ন সময়ে পূজাকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনায় জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলা হয়েছে, বিশেষ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। এই প্রেক্ষাপটে, দলটির আমিরের পক্ষ থেকে সরাসরি শুভেচ্ছা জানানো ও অন্য নেতাদের একের পর এক ঈমানবিধ্বংসী বেফাঁস মন্তব্যকে দলটির ভাবমর্যাদা পরিবর্তনের একটি চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু জামায়াতের অভ্যন্তরে এ নিয়ে প্রকাশ্য দ্বিমত এই ‘অসাম্প্রদায়িক’ বার্তা প্রচারের চেষ্টাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। অন্যদিকে, ইসলামি স্কলাররাও এর কঠোর নিন্দা ও সমালোচনা করায় বিপাকে পড়েছে জামায়াত।
সম্প্রতি দুর্গাপূজা পরিদর্শনে গিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজায় উপস্থিত হয়ে জামায়াতে ইসলামীর আলোচিত আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনিরের বক্তব্য ঘিরে আরেকটি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তিনি পূজার সঙ্গে রোজার তুলনা করায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। শিশির মনির এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা অনেকেই গ্রহণ করেননি। এই বিতর্কের পর শিশির মনির একটি গণমাধ্যমকে বলেন, তার বক্তব্যে কোনো ধর্মীয় মেলানো বা সমতুল্যতা বোঝানো হয়নি। তিনি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমা মিলেই বাংলাদেশ। বাংলাদেশ হলো বৃত্ত তার কুসুম হলো হিন্দু এবং মুসলমান, এটিই বুঝানো হয়েছে তার উল্লিখিত বক্তব্যটির ধারা।
এর আগে গত বছর, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা প্রফেসর মতিয়ার রহমান ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার বাজেবামনদাহ হরিতলা পালপাড়া পূজাম-পে গিতা পাঠ করে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি করেন। অন্যদিকে, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ সম্প্রতি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা:) নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করেন, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। ড. মাসুদ বলেন, ‘ইসলাম গ্রহণ করার আগে উমর রা. কী ছিল? সবচেয়ে জঘন্য মানুষ ছিল, পশু ছিল।’
এদিকে, অসাম্প্রদায়িক কার্ড খেলতে গিয়ে বিএনপির অনেক নেতাকেও জামায়াতের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে দেখা গেছে। দলটির কিছু নেতার পক্ষ থেকে পূজা উপলক্ষে দেয়া শুভেচ্ছা বার্তা ও মন্তব্য নেটিজেনদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এই শুভেচ্ছাকে অনেকে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে তীব্র বিতর্ক ও মন্তব্যের ঝড় উঠেছে। অথচ বিরোধী ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সতর্ক করে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বেগম খালেদা জিয়ার এ ধরনের সাহসী মন্তব্য আরো তাকে জনপ্রিয় করে তোলে, ভোটে বিজয়ী করে। কিন্তু আজকের বিএনপির কিছু নেতা ভুল পথে পা বাড়িয়ে হিন্দুতোষণ করতে গিয়ে দলের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে মনে করেন তারা।
ইসলামি স্কলার ড. এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী পবিত্র আজানের সাথে হিন্দুদের উলুধ্বনির তুলনার কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি এটিকে কুফরি বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, আজানের মতো একটি মহৎ ইসলামিক ইবাদতকে উলুধ্বনির সাথে তুলনা করা স্পষ্ট কুফরি কাজ, যা ওই নেতার ঈমান নষ্ট করে দিয়েছে।
ড. আব্বাসী ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে ভারত তোষণকারী ও হিন্দু ভোট আদায় করতে চাওয়া রাজনীতিবিদদের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি ‘শেয়ারে কওম’ (জাতিগত সংস্কৃতি, যেমনÑ শিরকমুক্তভাবে পালন করা পহেলা বৈশাখ) এবং ‘শেয়ারে মিল্লাত’ (ধর্মীয় পর্ব, যেমনÑ দুর্গাপূজা বা বড়দিন) এর মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেন। তার মতে, মুসলমানরা জাতিগত সংস্কৃতি পালন করতে পারলেও কোনোভাবেই বিধর্মীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারে না।
দুর্গাপূজায় উপস্থিত হয়ে জামায়াত নেতাদের শিরকি বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা করেছেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপির সভাপতি ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ। গত শুক্রবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্টে বলেন, ‘ভোটের জন্য আল্লাহ কে নারাজ করো না, পরে আল্লাহকেও পাবা না আর ভোটও কাজে আসবে না। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবেÑ এটি সুনিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করুক।’
ড্যাফোডিল সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক মো. মোখতার আহমাদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কয়টা ভোটের জন্য যেভাবে গণতান্ত্রিকরা ঈমান বিক্রি করে দিচ্ছে তাতে বিস্মিত হচ্ছি। আল্লাহ কি সর্বশক্তিমান নন? আল্লাহ কি সব ক্ষমতার উৎস নন? মহান আল্লাহ তো নিজেই বলেছেনÑ সমাজে, রাষ্ট্রে ক্ষমতাধর হতে হলে দু’টি কাজ করতে হয় : কেবল আল্লাহর ইবাদত এবং সব প্রকার শিরক থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি।’
ইঞ্জিনিয়ার আলম চৌধুরী লিখেছেন, ‘জামায়াত ও বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে লিখেছেন, আমি রাজনীতি করি বলে কি আমি মুসলিম পরিচয় ভুলে যাব। নেতার নির্দেশে পূজা পরিদর্শন বা উৎসব উপভোগ করতে হবে, এই চাপ ইসলাম কোথায় দিয়েছে। যে রাজনীতি আমার ঈমান ও আমল নষ্ট করে সে রাজনীতি না করলেই ভালো। আমার আগে ইসলাম, আগে আমার রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা:), আগে কুরআন ও হাদিস, আগে আল্লাহর বিধান। ভারতে মুসলিমদের নির্বিচারে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, নির্যাতন করা হচ্ছে, মুসলিম মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি করা হচ্ছে, কাশ্মীরে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করা হচ্ছে, কই এ নিয়ে তো আপনাদের আর প্রতিবাদ করতে দেখা যাচ্ছে না। কারণ এতে ভারত অখুশি হবে!’
মারুফ বিল্লাহ লিখেছেন, ‘যে রাজনীতি মুশরিকদের দলে টেনে নেয় সে রাজনীতি থেকে সরে আসুন। আপনারা এতদিন পূজাম-পে গেলেন না, এখন কেন যাচ্ছেন? আপনারা এতদিন ইসলামের নামে রাজনীতি করে আসলেন আর এখন ভারতের অনুকম্পা পেতে এবং হিন্দুদের সামান্য ভোট পেতে শিরকে জড়িয়ে ঈমান বিসর্জন দিলেন! আপনাদের দ্বারা এদেশে ইসলামের কোনো উপকার হবে বলে মনে হয় না। পূজাম-পের জন্য এবার প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তবু কেন নিরাপত্তার নামে আপনাদের সেখানে যেতে হবে। এই দায়িত্ব কি আপনাদের দেয়া হয়েছে? আপনাদের ভোটের রাজনীতি সবাই বুঝে। দয়া করে ইসলাম নিয়ে ধর্ম ব্যবসা বন্ধ করুন।’