Image description
জুলাই আন্দোলনে হত্যাচেষ্টা

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মী, সাবেক মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ কর্মকর্তা এবং অর্ধশত ব্যবসায়ীকে আসামি করে জুলাই আন্দোলনের হত্যাচেষ্টা মামলার আবেদন করা হয়েছে ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। মো. নূর আলম সাকিব (২১) নামের এক যুবক নিজেকে জুলাই যোদ্ধা ও গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত দাবি করে আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদনটি করেন। তবে নূর আলম সাকিব আসামি হিসেবে ৫৭ জনের নাম দিলেও আদালতে মামলার আবেদনে ৩১৯ জনের নাম দেখে হতবাক তিনি। এজাহারে বাদীর অজান্তে কিছু ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নাম এসেছে যাদের তিনি কখনো দেখেননি ও চিনেনও না। অচেনা আসামিরা এখন বাদীকে ফোন দিয়ে নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। 

এদিকে মামলার আবেদনের পর আদালত বিষয়টি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য থানা পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত মামলাটি রেকর্ডের কোনো নির্দেশনা আসেনি আদালতের তরফে। অভিযোগ উঠেছে- মামলার আবেদনের পর থেকে আসামিদের কাছে চাঁদাবাজির অভিযোগও উঠেছে। এমনকি যে স্থানে হামলার ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে হামলার কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই বাদীর কাছে।
বাদী নূর আলম সাকিব বলেন, আমি একজন এডভোকেটের কাছে আসামি হিসেবে ৫৭ জনের নাম দিয়েছিলাম। এরপর দেখি মামলার আবেদনে ৩১৯ জনের নাম দেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত নামগুলো কাটার জন্য অনেকদিন দৌড়েছি কিন্তু কাটতে পারি নাই। আর এখন আমি আর এই মামলা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। কারণ অচেনা আসামিরা আমাকে প্রায়ই ফোন দিয়ে হুমকি- ধমকি দিচ্ছে। আমি এখন প্রায়ই ফোন বন্ধ করে রাখি। তিনি বলেন, তারা মামলাটা এমনভাবে করে নিয়েছে এখন অচেনা নির্দোষ আসামিদের নাম বাদ দেওয়া কঠিন। 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশের  হামলার শিকার হন মো. নূর আলম সাকিব। চলতি বছরের ১ জুলাই ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নালিশি আবেদন করেন তিনি (ক্যান্টনমেন্ট আমলী আদালত, সিআর মামলা নম্বর-৩৫৮/২৫)। আবেদনটি আমলে নিয়ে গত ২৪শে জুলাই ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসিকে আদালত নির্দেশ দেন এ সংক্রান্তে কোনো মামলা হয়েছে কিনা। প্রতিবেদনটি ৩০ কার্য দিবসের মধ্যে আদালতে জমার জন্য বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করেছেন ক্যান্টনমেন্ট থানার সাবেক ওসি।

মামলার আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালের ২০শে জুলাই দুপুরে ছাত্র-জনতাকে প্রতিহত করার জন্য আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ১০০ থেকে ২০০ জনের একটি বিশাল মিছিল নিয়ে আসে। মিছিলকারীদের হাতে ছিল দেশি-বিদেশি অস্ত্র; যেমন- পিস্তল, ছুরি, রামদা, লোহার রড, লোহার পাইপ। তারা মিছিল নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানাধীন ইসিবি চত্বরে আসতে থাকলে বাদী নূর আলম সাকিবসহ পাঁচ-ছয়জনের ওপর হামলা শুরু করে। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা বাদী ও তার সঙ্গে থাকাদের দিকে গুলি চালায় এবং তারা দৌড়ে এসে অতর্কিত হামলা চালায়। তাদের হাতে থাকা লোহার রড, পাইপ সহ দেশি অস্ত্র দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয় এবং সাকিবকে জাপটে ধরে চিৎকার করতে থাকে- ‘জামায়াত, বিএনপি সন্ত্রাসীদেরকে ধরে ফেলেছি’ এবং পুলিশকে ডাক দিয়ে এনে বলে- ‘এরা জামায়াত, বিএনপি’র নাশকতাকারী। এদেরকে গুলি করে মেরে ফেলেন এবং পুলিশ তাদের নির্দেশে সাকিবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে তিনি জীবন বাঁচানোর জন্য আকুতি-মিনতি করতে থাকেন। কিন্তু তারপরও আসামিরা তার শরীরে আঘাত করতে থাকে এবং ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ বাহিনী ভুক্তভোগীদের দিকে লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে। তৎক্ষণে রাবার বুলেট বিদ্ধ হন সাকিব। তখন জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান তিনি। আসামিরা এলোপাতাড়ি পিটিয়ে, সাকিবের মাথায় আঘাত করে গুরুতর রক্তাক্ত আহত এবং অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায়। একপর্যায়ে তার জ্ঞান ফিরলে দেখতে পান তিনি মাটিকাটা নাহার ফার্মেসিতে। ফার্মেসিতে চিকিৎসা দেয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ অবস্থায় বাসায় থাকেন তিনি। গত ১৩ই সেপ্টম্বর সিএমএইচএ তার অপারেশন হয় এবং মাখা থেকে বুলেট বের করা হয়। ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি একেএম আলমগীর জাহান বলেন, তদন্ত শেষে যথাসময়ে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। এখনো মামলা রেকর্ড করার বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা আসেনি।  

সূত্র বলছে, মামলার আবেদনে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও পুলিশের উচ্চপর্যায়ের অনেকেই আছেন আসামির তালিকাতে। মামলার আবেদনে ২৭ নম্বরে নাম রয়েছে ব্যবসায়ী মিজান উদ্দিনের, ২৮ নম্বরে নাম রয়েছে ব্যবসায়ী খান মো. আক্তারুজ্জামানের, ২৮৮ নম্বরে নাম আছে ব্যবসায়ী মো. অমিত হাসান সোহাগের। এছাড়া আরও বেশ কিছু ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে। ব্যবসায়ী খান মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ঘটনার যে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে (২০২৪ সালের ২০শে জুলাই দুপুরে) সেদিন আমি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান (বর্তমান ভিসি) দিনভর উত্তরা রাজউক অফিসে ছিলাম। মূলত ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব থেকে প্রতিপক্ষ আমার নাম ঢুকিয়েছে। বাদী নূর আলম সাকিব বলেন, এসব ব্যবসায়ীকে আমি চিনি না। তাদের নামও আমি দেই নাই। ব্যবসায়ী আক্তারুজ্জামানের নাম কাটার চেষ্টা করেও পারি নাই।

সাকিবের যে আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা করেছেন তিনি হলেন এডভোকেট নাজমুল আহসান। তিনি মানবজমিনকে বলেন, বাদী যদি আসামিদের না চেনে তবে তিনি আদালতকে বলবেন তিনি আসামিদের চিনি না। ৫৭ জন ছাড়া বাকি আসামিদের রাখতে চাই না। একটা মামলা ফাইলিং হলে সেখানে অনেক আইনজীবী থাকেন। তারা সিলেক্ট করেন কোন কোন আসামি দিবেন। সিলেকশন আমি করি না। সেটা বারের সমিতির মাধ্যমে হয়। বাদী আমার ইউনিভার্সিটির ছোট ভাই। একজন আমার কাছে পাঠিয়েছে তাই আমি সাহায্য করেছি। ওকালতনামায়ও আমার কিছু নাই। তবে পলিটিক্যাল মামলা করলে বিভিন্নজন আসামি দেয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে বাদী বা ভুক্তভোগী যে সব আসামি দেবে- তেমনটা নয়। এক্ষেত্রে তার উচিত ছিল আমাকে ফাইলিং খরচ দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ১০/২০ জন আসামি দিয়ে মামলা করা। মামলা ফাইল হওয়ার পর অনেকের এখতিয়ার থাকে না। যা বলার বলতে হয় শুরুতে। তিনি বলেন, আমার কাছে প্রতিদিনই কেউ কেউ না কেউ আসে। নামটা বাদ দেয়ার জন্য। আসামি যোগ বিয়োগে চাঁদাবাজির বিষয়ে অভিযোগ নিয়ে তিনি বলেন, প্রমাণসহ সবমিট না করলে এসব কাউকে বলা যায় না।