Image description
ফেসবুকে শহিদুল আলম

ইউরোপ থেকে ত্রাণ নিয়ে অবরুদ্ধ গাজা অভিমুখে যাত্রা করা গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার সব জাহাজ ইসরায়েলি নৌ সেনাদের হাতে আটক হলেও নতুন আরও ৯টি জাহাজের বহর ফ্রিডম ফ্লোটিলার গাজা অভিমুখে ছুটে চলা অব্যাহত রয়েছে। গতকাল শনিবার ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে এ কথা নিশ্চিত করেন ফ্রিডম ফ্লোটিলার বহরের একটি জাহাজে অবস্থানরত বাংলাদেশের আলোকচিত্রী শহিদুল আলম।

তিনি জানান, যে জাহাজটিতে তিনি অবস্থান করছেন, সেই ‘কনসায়েন্স’ নামের জাহাজটি নতুন এ বহরের সবচেয়ে বড় জাহাজ। শুরুতে বহরের অন্য জাহাজগুলো থেকে তাদের জাহাজটি পিছিয়ে থাকলেও এখন সবগুলো জাহাজ একসঙ্গে গাজার দিকে এগোচ্ছে।

ফেসবুক পোস্টে শহিদুল আলম লেখেন, ‘থাউজেন্ড ম্যাডলিনস একটি অবিস্মরণীয় ধারণা। জাতিগত নিধন ঠেকাতে বিশ্বনেতাদের পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়তা এবং কপট ভূমিকার কারণে বিশ্বের জনগণ নিজেরাই পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হাজারো জাহাজের ধারণাটি প্রতীকী। তবে নিঃসন্দেহে এভাবে একত্রিত হওয়া সমুদ্রযানের সবচেয়ে বড় বহর এটি।’

কনসায়েন্স জাহাজটি বহরের জাহাজগুলোর মধ্যে সবার শেষে (৩০ সেপ্টেম্বর) ইতালি থেকে রওনা হয়েছিল জানিয়ে তিনি আরও লেখেন, ‘কনসায়েন্সের আগে ওই ৮টি নৌযান রওনা করেছিল। এ ছাড়া আরও দুটি নৌকাও আগে ছিল। তবে ওই দুটি নৌকার অবস্থান এখনো নিশ্চিত নয়। কনসায়েন্স সবার শেষে রওনা করলেও এটির গতি বেশি হওয়ায় আগে রওনা করা ৮টি নৌযানকে ছুঁয়ে ফেলেছে। এখন কনসায়েন্সের গতি কমানো হয়েছে এবং সব নৌযান একযোগে এগিয়ে যাচ্ছে।

গাজার অবরোধ ভেঙে দেওয়ার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে শহিদুল আলম লেখেন, ‘আমরা কনসায়েন্সের মানুষরা অবরোধ ভাঙতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারা যদি আমাদের আটকায়, তখন অন্যরা এগিয়ে আসবে। দমনপীড়নকারী কখনোই জনগণের শক্তির বিরুদ্ধে টিকতে পারেনি। ইসরায়েলও ব্যর্থ হবে। মুক্ত হবে ফিলিস্তিন।’

ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘কনসায়েন্স’ নামের জাহাজটিতে ২৫টি দেশের সাংবাদিক ও স্বাস্থ্যকর্মী আছেন। এফএফসির সর্বশেষ এ মিশন গত বুধবার যাত্রা শুরু করে। তবে তাদের বহরে কোনো খাদ্যসহায়তা নেই। ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গাজা অভিমুখে রওনা হয়েছে আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ও চিকিৎসকবাহী এই জাহাজ।

ফ্লোটিলার দুই নৌযানে ড্রোন হামলার অনুমতি দিয়েছিলেন নেতানিয়াহু: ইসরায়েলি নৌ সেনাদের হাত আটক হওয়া গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা বহরের দুটি নৌযানে অবৈধভাবে ড্রোন হামলা চালাতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরাসরি অনুমতি দিয়েছিলেন। গত মাসের শুরুতে এই অনুমতি দেওয়া হয়েছিল বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজ।

এ বিষয়ে অবগত মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর একটি পর্তুগিজ পতাকাবাহী নৌযান এবং একটি ব্রিটিশ পতাকাবাহী নৌযানকে আলাদা করে নিশানা করা হয়েছিল। তবে ওই হামলায় কেউ হতাহত হয়নি। প্রকাশ্যে কথা বলার অনুমতি না থাকায় ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, ইসরায়েলি বাহিনী একটি সাবমেরিন থেকে ড্রোন উড়িয়ে তিউনিসিয়ার সিদি বো সাঈদ বন্দরের বাইরে নোঙর করা নৌযানগুলোয় দাহ্য সরঞ্জাম ফেলে। এতে সেগুলোয় আগুন ধরে যায়।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও সশস্ত্র সংঘাত সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী, যে কোনো পরিস্থিতিতেই বেসামরিক মানুষ বা বেসামরিক স্থাপনার ওপর দাহ্য সরঞ্জাম দিয়ে হামলা নিষিদ্ধ। নেতানিয়াহু এ ব্যাপারে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীও তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৪০টির বেশি নৌযান নিয়ে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নৌবহরটি গাজার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। এসব নৌযানে প্রায় ৫০০ লোক ছিলেন।

আটক অধিকারকর্মীদের খাবার-চিকিৎসা দেয়নি ইসরায়েল: ফিলিস্তিনের গাজা অভিমুখী ত্রাণবাহী নৌবহর ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার’ নৌযানগুলো থেকে আটক অধিকারকর্মীদের ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে খাবার ও চিকিৎসাসেবা দেয়নি বলে জানিয়েছে ইসরায়েলে আরব সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থা ‘আদালাহ’। হোয়াটসঅ্যাপে প্রকাশ করা এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, আশদোদ বন্দরে প্রবেশের সুযোগ দিতে আদালাহের আহ্বান বারবার খারিজ করে দিয়েছিল ইসরায়েলি পুলিশ। তবে শেষ পর্যন্ত বন্দরটিতে প্রবেশ করতে সক্ষম হন সংস্থাটির সদস্যরা। সেখানে ইসরায়েলের হাতে আটক থাকা ৩৩১ জন অধিকারকর্মীকে পরামর্শ দেন তারা। অনেক অধিকারকর্মীকে হয়রানি ও হুমকি দেওয়া হয়। এমনকি ঘুমের মধ্যে সহিংস আচরণ করে ঘুম থেকে তোলা হয়।

আদালাহ আরও জানায়, আটক অধিকারকর্মীদের ইসরায়েলের নেগেভ অঞ্চলে কেতজিওত কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আগে থেকে তাদের আইনজীবীদের জানানো হয়নি। অমানবিক পরিবেশের জন্য এ কারাগারের কুখ্যাতি রয়েছে।

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার বহরে থাকা ৪০টির বেশি নৌযানের সবকটি আটকের পর এ বহরের জাহাজগুলোয় থাকা ৪৬১ জন অধিকারকর্মীকে আটক করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এই অধিকারকর্মীদের মধ্যে সুইডিশ অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গও রয়েছেন।

আটক ১৩৭ জনকে তুরস্কে ফেরত পাঠিয়েছে ইসরায়েল: গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে আটক করা অধিকারকর্মীদের মধ্যে ১৩৭ জনকে তুরস্কে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল। এই অধিকারকর্মীরা ইস্তাম্বুলে ফিরেছেন বলে গতকাল নিশ্চিত করেছে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও।

ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাতে আলজাজিরা জানিয়েছে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার বহরে থাকা ১৩৭ জন কর্মীকে ইসরায়েল থেকে তুরস্কে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী তাদের আটকের পর ইসরায়েলে নিয়ে গিয়েছিল।

‘শহিদুল আলম বাংলাদেশের অবিচল মনোবলের এক উজ্জ্বল প্রতীক’: গাজা অভিমুখী ঐতিহাসিক নৌবহরে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের বিশেষ করে আলোকচিত্রী এবং মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলমের অবস্থা ও নিরাপত্তা সরকার নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

গতকাল এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ২০১৮ সালে হাসিনা সরকারের সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য ১০৭ দিন কারাবাসের যে সাহস, দৃঢ়তা ও অবিচল মানসিকতা শহিদুল আলম দেখিয়েছিলেন, সেই একই চেতনা ও সাহস নিয়ে তিনি এই অভিযানে অংশ নিচ্ছেন। তিনি আজ বাংলাদেশের অবিচল মনোবলের এক উজ্জ্বল প্রতীক।

গত মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া নিজের বক্তব্য উদ্ধৃত করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘অন্যের দুর্ভোগ ও পীড়নের প্রতি ঔদাসীন্য বহু দশকের পরিশ্রমে আমরা যে অগ্রগতি অর্জন করেছি, তা ধ্বংস করে দিচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এর সবচেয়ে মর্মান্তিক চিত্র আমরা দেখছি গাজায়। শিশুরা না খেয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করছে, বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, হাসপাতাল, স্কুলসহ একটি গোটা জনপদ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে। আমরা শহিদুল আলমের পাশে আছি, গাজার পাশে আছি— এখন এবং চিরকাল।’