Image description
অবৈধ প্রকল্পের বিস্তার

মাত্র ৫০ হাজার টাকার নিবন্ধন ফি জমা দিয়ে হাউজিং ব্যবসায় নাম লেখাচ্ছে অসংখ্য কোম্পানি। জমি নেই, অবকাঠামো নেই, এমনকি কর্মীসংখ্যাও নিয়ম অনুযায়ী নেই। তবু সাইনবোর্ড টানিয়ে তারা বিক্রি করছে হাজার কোটি টাকার প্লট ও ফ্ল্যাট। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের দেওয়া এই নিবন্ধনই যেন হয়ে উঠেছে প্রতারণার লাইসেন্স। কাগজে-কলমে নিয়ম থাকলেও বাস্তবে কোনো তদারকি নেই। ফলে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা এসব কোম্পানি কৃষিজমি ও জলাভূমি গিলে খেয়ে আবাসিক প্রকল্প বানাচ্ছে দাপটের সঙ্গে। গৃহায়ন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, জনবল সংকট আর রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তারা কার্যত অসহায়।

জাতীয় গৃহায়ন ও ঢাকা জেলার পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ঢাকার আশপাশে অবৈধভাবে দুইশ থেকে আড়াইশ হাউজিং কোম্পানি নামে-বেনামে ব্যবসা করছে। এসব কোম্পানির কোনোটার পুঁজি মাত্র ৫০ হাজার টাকায় নিবন্ধন ফি। কোনো কোনো কোম্পানির পুঁজি বলতে একটি মাত্র সাইনবোর্ড। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান উপজেলায় সবচেয়ে বেশি। এ উপজেলায় আছে ২১টি আবাসন প্রকল্প। সিরাজদীখান উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১০ বছর আগে সিরাজদীখানে কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৪৩০ হেক্টর। ১০ বছরে ৫৪০ হেক্টর কমে বর্তমানে কৃষিজমি রয়েছে ১৩ হাজার ৮৯০ হেক্টর এবং বছরে খাদ্য উৎপাদন কমেছে প্রায় ৭৫০ টন।

এ ছাড়া ঢাকা জেলার আশপাশে নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা ১০৮টি। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশই তাদের খেয়ালখুশিমতো ব্যবসা করছে বলে জানিয়েছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, কোনো হাউজিং কোম্পানির নিবন্ধন করতে হলে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমির উল্লেখ করতে হয় না। এর বেশিরভাগই কৃষিজমি-জলাভূমি, খাল-নালা দখল করে রাতের আঁধারে বালু ভরাট করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলছে।

গৃহায়ন সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প নিতে নতুন করে প্রায় ৭০টি কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছে তারা। তবে বেশিরভাগই গুরুত্ব দিচ্ছে না। কারণ, এসব কোম্পানি বহু আগে থেকেই প্রকল্পের আদলে সব কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ এবং বিধিমালা, ২০১১ অনুসারে গৃহায়নের নিবন্ধন ব্যবহার করে কোনো প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রি করার আইনগত বৈধতা রাখে না। কিন্তু এসব আইন মূলত কাগজে-কলমেই থাকছে, বাস্তবায়নে প্রয়োগ নেই। এমনকি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়াকে গুরুত্ব মনে করছে না হাউজিং কোম্পানিগুলো।

জাতীয় গৃহায়নের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ১০৮টি রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার কোম্পানি নিবন্ধন নিয়েছে। ৩৬টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন সনদের শর্ত ভঙ্গ করায় তাদের সনদ বাতিল করা হয়। অবশিষ্ট ৭২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩০টি কোম্পানির নিবন্ধনের মেয়াদ বহাল রয়েছে। ৬৪টি ডেভেলপার কোম্পানিকে গত ১৩ জুলাই কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ১৫ থেকে ১৬ দিন পর অর্থাৎ ২৮ এবং ২৯ জুলাই কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিদের শুনানির আয়োজন করা হয়। কিন্তু ৬৪টি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৮ জুলাই ১৬টি প্রতিষ্ঠান এবং ২৯ জুলাই ২০টি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়ে কমিটির সামনে লিখিত জবাবসহ শুনানিতে অংশ নেন। তিনটি প্রতিষ্ঠান শুধু লিখিত জবাব দেয়, যা সন্তোষজনক নয়। শুনানিতে অংশগ্রহণ এবং লিখিত জবাব দাখিল না করায় ২৫টি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৬টি প্রতিষ্ঠানে পাঠানো চিঠি ঠিকানা পরিবর্তনের কারণে ফেরত আসে। ৯টি প্রতিষ্ঠান কোনো জবাব প্রদান বা শুনানিতে অংশ নেয়নি। ‘পরিবর্তন প্রাইভেট লিমিটেড’ ও ‘সিনাম ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’-এর কোনো কার্যক্রম না থাকায় বাতিল হতে পারে এই দুটি কোম্পানির নিবন্ধন।

গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ আরও বলছে, ১০৮টি নিবন্ধিত কোম্পানির মধ্যে সরকারের নিয়ম না মানা ও নিবন্ধন নবায়ন না করার কারণে ৩৬ কোম্পানিকে বারবার চিঠি দিয়েছে গৃহায়ন; কিন্তু তারা পাত্তা না দিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রির বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। এরপর গত ৯ মার্চ এসব কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল করে প্রকল্প থেকে প্লট-ফ্ল্যাট ক্রয় কার্যক্রম গ্রহণ থেকে জনসাধারণকে বিরত থাকতে বলা হয়। তাতেও গৃহায়নের কাছে ধরা দেয়নি কোম্পানিগুলো। এখন পর্যন্ত তারা বিরামহীনভাবে বাণিজ্য করে যাচ্ছে। নতুন করে আরও ২০টি কোম্পানির নিবন্ধন বাতিলের প্রস্তুতি চলছে। তাদেরও চিঠি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু গৃহায়নকে পাত্তাই দিচ্ছে না।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১০৮ কোম্পানির মধ্যে মাত্র চারটি কোম্পানি পরিবেশ ছাড়পত্র নিয়েছে। প্রথমে ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে আমিন মোহাম্মদ ল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (আশুলিয়া মডেল টাউন) পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নেয়। এরপর ২০০৫ সালের ২৬ মে ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট প্রো. লিমিটেড (বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্প) এবং একই বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কো. লি. (সাউথ টাউন হাউজিং প্রকল্প) ছাড়পত্র নেয়। ২০০৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৭ বছর দেশে বিভিন্ন কোম্পানি ব্যবসা করলেও কোনো ছাড়পত্র নেয়নি। তবে ২০২৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মধুসিটি আঁটি বাজার রোড, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা (রাহাত অ্যান্ড রিফাত রিয়েল এস্টেট লি.) ছাড়পত্র নেয়।

এ বিষয়ে গৃহায়নের কর্মকর্তারা কালবেলাকে জানান, সরকারি নিয়মের ধারেকাছেও থাকে না কোম্পানিগুলো। ফলে অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। আইন আছে, কিন্তু লোকবল নেই। স্থানীয় প্রশাসনও আগ্রহ দেখায় না। স্থানীয় বা রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া প্রতিটি রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির আছে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কোম্পানিগুলোর যোগসাজশও থাকে। আবার কোম্পানি লোকালয়ে গড়ে ওঠায় তাদের স্থানীয় ও রাজনৈতিক একটি বলয় তৈরি হয়। তাই প্রশাসন এসব কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ করতে গেলে উল্টো হামলার শিকার হতে হয়। সরকারি সংস্থা তাদের কাছে অসহায়। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে কেউ এসব অভিযান করতে চায় না। এ ছাড়া এসব কোম্পানি থেকে স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন সংস্থা বা গৃহায়নসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান জড়িত, তারাই মাসে মাসে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে থাকে। এজন্য গৃহায়ন কর্তৃপক্ষও বিষয়টি জেনেশুনে নীরব।

অভিযোগ রয়েছে, নিবন্ধিত কোম্পানি ছাড়াও নামে-বেনামে অবৈধভাবে শতাধিক কোম্পানি ব্যবসা করছে। বিশেষ করে রাজধানী লাগোয়া কেরানীগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের মতো জায়গায় এরকম অসংখ্য সিটি গড়ে উঠেছে। এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে জাতীয় গৃহায়ন ও পরিবেশ অধিদপ্তর বড় কোনো অভিযান পরিচালনা করতে পারেনি। এমনকি, নিবন্ধিত অনেক কোম্পানির বিরুদ্ধেও গ্রাহকের প্লট-ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও কোনো অভিযান পরিচালনা করতে পারেনি জাতীয় গৃহায়ন।

নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি কোম্পানিকে লে-আউট তৈরি বা প্লট করার আগে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগে। কিন্তু অনেক রিয়েল এস্টেট কোম্পানি এ বিধানের তোয়াক্কা করছে না। নিজেদের ইচ্ছামতো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্লট তৈরি না করেই জমি বিক্রি ও প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোয় যে সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার নিয়ম, সেটিও তাদের নেই। নিয়ম অনুযায়ী, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার দুই মাসের মধ্যে নিবন্ধন সনদ নবায়ন করতে হয়। অথচ সনদ বাতিল হওয়া ৩৬টি কোম্পানি এবং নতুন করে বাতিলের তালিকায় ২০টি কোম্পানির অধিকাংশেরই সনদ ৫ থেকে ৯ বছর ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ। সনদ নবায়ন না করায় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ এসব কোম্পানিকে একাধিকবার চিঠি ও কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। কারণ দর্শানোর শুনানিতে অংশগ্রহণ করার জন্য ডাকা হলেও তারা শুনানিতে আসেনি। লিখিত জবাব চাওয়ার পরও সন্তোষজনক জবাব দেয়নি। এসব কোম্পানির অফিসের যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, সেখানে গিয়ে অফিস খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন জাতীয় গৃহায়নের কর্মকর্তারা। পরে তাদের নিবন্ধন সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে জাতীয় গৃহায়নের চেয়ারম্যান ফেরদৌসী বেগম কালবেলাকে বলেন, ‘সবকিছুর জন্য আইন আছে। কোনো কোম্পানি যদি নিয়ম লঙ্ঘন করে কার্যক্রম পরিচালনা করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’