
পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল—শুধু রোগীর ভিড় আর ওষুধের গন্ধেই ভরা নয়, ভেতরে ভেতরে রাজনীতি, প্রভাব আর ক্ষমতার এক অদৃশ্য সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে বহুদিন ধরে। চতুর্থ শ্রেণির দুই কর্মচারী—মোজাফফর হোসেন বাবুল ও তার স্ত্রী নাছরিন আক্তার সেই সাম্রাজ্যের মুখ্য চরিত্র। পদবি তাদের ‘অফিস সহায়ক’; কিন্তু আচরণ, প্রভাব আর দাপট কর্তাদেরও ছাড়িয়ে যায়। সাবেক সংসদ সদস্য হাজী সেলিম ও তার ছেলে ইরফান সেলিমের নাম ভেসে থাকত তাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের আড়ালে। পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা—সবার কাছেই তারা পরিচিত ‘হাজী সেলিমের ভূত’ নামে। হাজী সেলিম না থাকলেও তার ভূত এখনো রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের প্রভাব ভাঙতে একসময় বদলির নির্দেশ দিলেও শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বদলির আদেশ জারি হয়; কিন্তু বাবুল-নাছরিনের প্রভাবশালী সিন্ডিকেট সেই নির্দেশ কাগজেই থামিয়ে দেয়। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—সরকার বদলালেও কীভাবে এক অফিস সহায়ক দম্পতি এখনো পুরো মিটফোর্ড হাসপাতালকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে?
এই প্রতিবেদনে উঠে আসছে সেই দম্পতির দাপট, সিন্ডিকেট, অভিযোগ আর প্রভাবের অন্ধকার গল্প।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এক মাস ধরে বদলির আদেশ লঙ্ঘন করে তারা নতুন কর্মস্থলে যোগ না দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে সেই আদেশ বাতিল করে ফেলেন! স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে গত ১ সেপ্টেম্বর বাবুল-নাছরিন দম্পতির বদলির আদেশ জারি হলেও ২৪ সেপ্টেম্বর সেই আদেশ বাতিল করতে ‘বাধ্য’ হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে শুরু করে মিটফোর্ড হাসপাতাল পর্যন্ত প্রশ্ন উঠেছে, পতিত সরকারের সাবেক একজন এমপির দোসর এ কর্মচারী দম্পতির প্রভাব নিয়ে।
মিটফোর্ড হাসপাতালে কর্মকর্তা-কর্মচারী সূত্র বলছে, ওই দম্পতির বদলির আদেশ হওয়ার পর থেকেই তাদের সিন্ডিকেটের সদস্যরা আদেশ বাতিল করবেন বলে বলাবলি শুরু করেন। ‘যত টাকা লাগে, তা দিয়ে’ মিটফোর্ডে থেকে যাওয়ার কথা বলেন তারা। শেষ পর্যন্ত সেই বদলি তারা ঠেকানোর পর হাসপাতালজুড়ে নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
১ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অফিস আদেশে দেখা যায়, অফিস সহায়ক মোজাফফর হোসেনকে ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহায়কের শূন্যপদে বদলি করা হয়। তার স্ত্রী নাছরিন আক্তারকে নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহায়কের শূন্যপদে বদলির আদেশ দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. এ বি এম আবু হানিফ ওই অফিস আদেশে স্বাক্ষর করেন। তাতে বলা হয়, আদেশ জারির সাত কর্মদিবসের মধ্যে ওই দুই কর্মীকে বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগদানের উদ্দেশ্যে ছাড়পত্র নিতে হবে। অন্যথায় তারা আট কর্মদিবস থেকে সরাসরি অব্যাহতি পেয়েছেন বলে গণ্য হবে।
যদিও মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রশাসনিক অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই দুই কর্মচারী অফিস থেকে ছাড়পত্রের আবেদন করেননি। পাশাপাশি কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুল মোকাদ্দেসের সঙ্গে কালবেলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মো. মোজাফফর হোসেন নামে কোনো অফিস সহায়ক যোগ দিতে আসেননি। নাছরিনের বিষয়ে একই তথ্য দেন নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এস এম সাখাওয়াত হোসেন।
অবশ্য ২৪ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জারি করা আদেশে বলা হয়, ১ সেপ্টেম্বর মোজাফফর হোসেন ও নাছরিন আক্তারের বদলি সংক্রান্ত অফিস আদেশটি বাতিল করা হলো। তাতেও স্বাক্ষর করেন অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. এ বি এম আবু হানিফ।
দুই কর্মীকে বদলির পর যোগ না দেওয়া এবং সেই আদেশ বাতিল করার বিষয়ে জানতে চাইলে গত বৃহস্পতিবার অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. এ বি এম আবু হানিফ কালবেলার কাছে শুরুতে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘এমন তো হওয়ার কথা নয়।’ তাকে জানানো হয়, তার স্বাক্ষরে বদলির আদেশের পর ফের তার স্বাক্ষরেই তা বাতিল করা হয়েছে। তখন তিনি বলেন, বিষয়টি দেখে তিনি জানাবেন।
মিটফোর্ড হাসপাতালে চাউর রয়েছে, এ বদলির আদেশ বাতিল করতে বড় অঙ্কের অর্থের লেনদেন হয়েছে—এমন প্রশ্নে পরিচালক বলেন, এমন হওয়ার সুযোগ নেই।
এদিকে মিটফোর্ড হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও বাবুল-নাছরিন দম্পতির ক্ষমতার দাপট কমেনি এতটুকু। চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতির সভাপতি পরিচয়ে স্ত্রীকে নিয়ে সিন্ডিকেট চালাচ্ছেন নিয়মিতই। ভোল পাল্টে তারা সিন্ডিকেট ধরে রাখতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। যদিও দুজনের কেউই সশরীরে কর্মস্থলে আসেন না। অপকর্মে তাদের ‘অভিজ্ঞতার’ কারণে একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীও এ দম্পতিকে ধরে রাখতে চাচ্ছেন।
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে এ দম্পতি হাজী সেলিম ও তার ছেলে ইরফান সেলিমের নামে হাসপাতালের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাদের ‘অনুমতি’ ছাড়া হাসপাতালের কর্মীদেরও অভ্যন্তরীণ বদলি পর্যন্ত করা যেত না। কেনাকাটা থেকে শুরু করে নিয়োগ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতেন নিম্নপদস্থ ওই দুই কর্মী। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে নিজেদের সিন্ডিকেটের লোকজন দিয়ে বলয় তৈরি করে টিকে থাকেন তারা। বাবুল নিজে কর্মচারী সমিতির সভাপতি পদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। কর্মচারীদের নেতা হওয়ায় নির্দিষ্ট কোনো বিভাগে দায়িত্ব পালন না করলেও স্ত্রী নাছরিন ছিলেন লেবার ওয়ার্ডের অফিস সহায়ক।
হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা জানান, বাবুল ও স্ত্রী নাছরিন যেন মিটফোর্ড হাসপাতালের মালিক ছিলেন। তারা হাসপাতালের মালিকানাধীন সব দোকান বরাদ্দ থেকে শুরু করে ভাড়া পর্যন্ত তুলে নেন। কেউ তাদের অপকর্মের বিষয়ে কথা বললেও হাজী সেলিম ও তার ছেলেদের ভয় দেখাতেন। হাসপাতালে কর্মচারী সমিতির অফিসটি বাবুল হাজী সেলিমের পারিবারিক গ্যালারিতে রূপান্তর করেছিলেন।
হাসপাতালের একাধিক কর্মী বলছেন, স্বামীর দাপটে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) গাড়ি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে ছিলেন নাছরিন। লেবার ওয়ার্ড থেকে আয়াদের মাধ্যমে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা আদায়, এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে কর্মচারী বদলিতেও লাখ টাকা নিতেন তিনি।
মিটফোর্ড হাসপাতালকেন্দ্রিক একাধিক অ্যাম্বুলেন্স মালিক ও চালক জানিয়েছেন, বাবুল সিন্ডিকেটকে টাকা না দিয়ে হাসপাতাল কম্পাউন্ডে তাদের অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে পারে না। প্রতি মাসে তাদের টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া বাবুল সিন্ডিকেট হাসপাতাল থেকে আইসিইউ রোগী বাগিয়ে নেওয়ার সিন্ডিকেটও চালায়। গোটা হাসপাতালে ক্লিনিকের দালালদের অবাধে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়ে আশপাশে গড়ে ওঠা ক্লিনিকগুলোতে রোগীদের নানা ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা করাতে বাধ্য করে এ সিন্ডিকেট।
হাসপাতাল সূত্র বলছে, বাবুল দম্পতির সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে, তারা ২০২৩ সালে হাসপাতালের আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছিল। দেড় কোটি টাকা মূল্যের ওই মেশিন বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নেন বাবুল। ওই ঘটনায় দুদকে মামলা হলে তদন্ত শেষে বাবুল ও তার সিন্ডিকেটের কয়েক সদস্যের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় দুদক। এরপরও ক্ষমতার প্রভাবে তার কিছুই হয়নি তখন। এ ছাড়া ডাকাতি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে এ বাবুল একসময় সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন। হত্যা, অপহরণসহ কেরানীগঞ্জ, কোতোয়ালি, সূত্রাপুরসহ বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে অন্তত ১৬ মামলা রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের আমলে তিনি ছিলেন বহালেই।
হাসপাতালের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরের ৯ জুলাই মিটফোর্ড হাসপাতাল কম্পাউন্ডের ভেতর নৃশংসভাবে ব্যবসায়ী লালচাঁন সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরও নাম আসে এ মোজাফফর হোসেন বাবুলের। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে এজাহার থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়। যদিও সোহাগ হত্যার ঘটনাস্থলে এখনো বাবুলের বিচারের দাবিতে ব্যানার ঝুলছে।
নিহত সোহাগের ভাগ্নী মোসাম্মৎ বীথি কালবেলাকে বলেন, ‘তার মামার সঙ্গে বাবুলের ঝামেলা ছিল। এজন্য হত্যা পরিকল্পনা বাবুলের মিটফোর্ড হাসপাতালের অফিসেই হয়েছিল। তাকে পরিকল্পনাকারী হিসেবে আমরা আসামি দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে সে নামটি কেটে দিয়েছে।’
এসব বিষয়ে জানতে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার মিটফোর্ড হাসপাতালে গেলেও বাবুলকে তার অফিসে পাওয়া যায়নি। পরে বক্তব্য জানতে বাবুলের একাধিক মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তাতে কল করা হলেও সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়।
মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রশাসনিক সূত্র বলছে, মূলত সোহাগ হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল আর অফিস করেননি। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তার হাজিরা খাতায় অনুপস্থিত লেখা রয়েছে।
ফোনে বাবুলের স্ত্রী নাছরিন আক্তার কালবেলাকে বলেন, তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, সব মিথ্যা ও বানোয়াট। এসবের কোনো ভিত্তি নেই। তিনি বলেন, লেবার ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করলেও কোনো টাকা কখনো নেননি। অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, তাদের দুটি অ্যাম্বুলেন্স ছিল, তা-ও বিক্রি করে দিয়েছেন।
বদলির আদেশ ঠেকানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ১ সেপ্টেম্বর তাদের বদলির আদেশ হলে তারা ৪ সেপ্টেম্বর আদালতে এর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। সে অনুযায়ী তাদের আদেশ বাতিল হয়েছে।
যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক শাখার সূত্র বলছে, বাবুল দম্পতির বিরুদ্ধে হাসপাতাল থেকে নানা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছিল। এসব অভিযোগ যাচাই করে সিন্ডিকেট ভাঙতে স্বামী-স্ত্রীকে পৃথক কর্মস্থলে বদলি করা হয়েছিল। ২৪ সেপ্টেম্বর তাদের সেই আদেশ বাতিল হলেও আদালতের আদেশ অধিদপ্তরে আসেনি।