Image description
 

রংপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে বছরের পর বছর ধরে ঝুলছে পাঁচ হাজারের বেশি মামলা। এর মধ্যে ১৮ থেকে ২০ বছরের পুরোনো মামলাও রয়েছে। দিনের পর দিন আদালতের বারান্দায় ঘুরলেও মামলার তেমন অগ্রগতি নেই। এসব মামলার বিচারকাজ শেষ না হওয়ায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা।

আইনজীবী ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, রংপুরের তিনটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঁচ হাজারের বেশি মামলার জট লেগে আছে। এর মধ্যে দুই হাজারের বেশি মামলা ধর্ষণের। তার মধ্যে তিন শতাধিক মামলার বিচারকাজ ১৮-২০ বছর ধরে চলছে। এজন্য আইনের সঠিক প্রয়োগ, আদালতে সাক্ষী হাজিরের ব্যাপারে পুলিশের দায়িত্বহীনতা এবং মামলা পরিচালনায় ধীরগতিকে দায়ী করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

বিচারের অপেক্ষা

পীরগঞ্জের একটি গ্রামের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এক কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ২০২০ সালে। ওই বছর মামলা হলেও পাঁচ বছরেও বিচার শুরু হয়নি। ভুক্তভোগী কিশোরীর বাবা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সহায় সম্বল যা ছিল; সব বিক্রি করে মামলার প্রতি তারিখে আদালতে আসি। উকিল, মুহুরি আর পেশকারকে মামলার খরচ দিই। তারপর নতুন তারিখ পড়ে। এভাবে পাঁচ বছর ধরে আদালতে টাকা দিচ্ছি আর বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। বিচারের অপেক্ষায় আছি। আর কিছুই করার নেই।’ 

একই কথা বলেছেন মিঠাপুকুর উপজেলার এক নারী। তিনি জানিয়েছেন, ২০২১ সালে তার মেয়েকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল। ওই বছর মামলা করেছিলেন। গত চার বছরেও বিচারকাজ শুরু হয়নি।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের তিনটি আদালত থাকলেও ৩ নম্বর ট্রাইব্যুনালের বিচারক কয়েক মাস আগে বদলি হয়েছেন। সেখানে নতুন বিচারক এখনও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এই ট্রাইব্যুনালে দেড় হাজারের বেশি মামলার বিচারকাজ গত তিন মাস ধরে অচল অবস্থায় আছে। 

বদরগঞ্জ উপজেলার এক নারী জানিয়েছেন, যৗতুক না দেওয়ায় তার স্বামী নির্যাতন করে বাড়ি থেকে বের করে দেন। থানায় গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। পাঁচ বছর আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। তিনি বলেন, ‘মামলা করার পর থেকে প্রতি মাসে আদালতে আসছি। কিন্তু বিচারকাজ হচ্ছে না। কবে বিচার পাবো জানি না। আমার বাবা গরিব মানুষ। এখন মামলার খরচ চালানো অসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

একই অভিযোগ করেছেন পীরগাছা উপজেলার আরেক নারী। তিনি জানান, স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। প্রতিবাদ করায় এক বছরের মেয়েসন্তানসহ বাসা থেকে বের করে দেন। এ ঘটনায় ছয় বছর আগে ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। এখনও বিচার শেষ হয়নি। কবে শেষ হবে, তাও জানেন না এই বাদী।

পিপি বললেন দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা চলছে

এ বিষয়ে রংপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিশেষ পিপি মোকসেদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি কয়েক মাস হলো দায়িত্ব নিয়েছি। ট্রাইব্যুনাল-২-এ ২০০৩ সালের বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। বিচারক সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা করছেন। সাক্ষ্যগ্রহণের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি আমি।’

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিশেষ পিপি সফি কামাল বলেন, ‘তিনটি ট্রাইব্যুনালে পাঁচ হাজারের মতো মামলা রয়েছে। আমরা সেগুলোর বিচারকাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছি। তবে এটা সত্য, ১৮ থেকে ২০ বছরের পুরোনো অনেকগুলো মামলা বিচারাধীন। সেগুলোও নিষ্পত্তির চেষ্টা করছেন বিচারক।’

তিন কারণে বিচারে ধীরগতি

রংপুরের সিনিয়র আইনজীবী ও ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ রইছ উদ্দিন বাদশা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মূলত তিন কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলাগুলোর বিচারকাজ বিলম্বিত হচ্ছে। প্রথমত তদন্তের নামে বছরের পর বছর পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তার কালক্ষেপণ, দফায় দফায় আদালতে আবেদন করে সময় নেওয়া এবং তৃতীয়ত সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পুলিশের অনীহা। এসব কারণে বিচারকাজ বিলম্বিত হচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাদী ও আসামি দুই পক্ষই।’

উল্টো হয়রানির শিকার

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রংপুর মহানগর নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আইনজীবী পলাশ কান্তি নাগ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলাগুলোর বিচারকাজ বছরের পর বছর ঝুলে আছে। এসব মামলার বাদীরা এমনিতেই নির্যাতনের শিকার, তার ওপর বিচার পাচ্ছেন না। সহায় সম্বল বিক্রি করে আদালতে আসছেন। অথচ কোনও কোনও মামলার বিচারকাজই শুরু হয়নি। আদালতে প্রতি মাসে আসেন আর খরচ দিয়ে খালি হাতে বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু বিচার শেষ হচ্ছে না। উল্টো হয়রানির শিকার হন। এভাবে আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা তৈরি হয় বাদীদের। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের ভালোভাবে দেখা উচিত।’