
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও অবকাঠামোর নাম। দুই-তিন দশকের পুরোনো প্রতিষ্ঠানের নামও হুট করে বদলে দেওয়া হচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম নিজেদের নামে করতে তৎপর হয়ে ওঠে। নামকরণ আর নাম বদলের এই খেলায় একদিকে রাষ্ট্রীয় অর্থের বিপুল অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে তৈরি হচ্ছে নাম নিয়ে বিভ্রান্তি। এই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বিশ্বের সামনে বাংলাদেশকে হাস্যকর হিসেবেও তুলে ধরছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকেই নামকরণ ও নাম পরিবর্তনের এই সংস্কৃতি শুরু হয়। রাজনৈতিক নেতাদের নাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কিংবা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে বিভিন্ন স্থাপনার নাম বদলানো হয়েছে। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জোট সরকারের আমলে দেশের কিছু স্থাপনা দলীয় নামকরণ পায়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক নামকরণ ও নাম পরিবর্তন প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৬ বছরে শেখ পরিবার ও দলীয় নেতাদের নামে করা প্রায় ৯৭৭টি ভবন বা অবকাঠামো চিহ্নিত করে এগুলোর নাম পরিবর্তন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আট শতাধিক নাম এরই মধ্যে পরিবর্তন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নাম পরিবর্তনের সবচেয়ে আলোচিত উদাহরণ হলো ঢাকার বিমানবন্দরটি। ১৯৭৯ সালে বিমানবন্দরটি তেজগাঁও থেকে কুর্মিটোলায় স্থানান্তরের আলোচনায় এটার নাম ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। পরে বিমানবন্দরটি উদ্বোধনের সময় নামকরণ করা হয় ‘জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এসে এর নাম বদলে রাখে ‘হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্যমতে, এই নাম পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় ওই সময়ে খরচ হয় প্রায় ১,৪০০ কোটি টাকা। সাইনবোর্ড, ব্যানার, নথিপত্র পরিবর্তনের পাশাপাশি সারা পৃথিবীকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে হয়। শুধু বিমানবন্দরের ক্ষেত্রেই নয়, দেশের বিভিন্ন সড়ক, কলেজ, স্টেডিয়াম, এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামও রাজনৈতিক কারণে বদলানো হয়েছে। প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন প্রক্রিয়া থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচবার বদলানো হয়েছে ঢাকার নভোথিয়েটারের নাম। প্রথমে ১৯৯৬ সালে ‘ঢাকা নভোথিয়েটার’ নামে প্রকল্পের প্রস্তাব একনেকে উপস্থাপিত হয়। পরের বছর এর নাম পরিবর্তন করে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার’ নামকরণ করে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয়। ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর প্রকল্পটির নামকরণ করা হয় ‘ঢাকা আধুনিক নভোথিয়েটার’। উদ্বোধনের আগে তৃতীয় দফা নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এবার নাম পরিবর্তন করে ‘ভাসানী নভোথিয়েটার’ রাখা হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে চতুর্থ দফায় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার’ নামকরণ করে ২০১০ সালে। চলতি বছর ২০ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে নাম থেকে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শব্দগুলো বাদ দেয়। শাহবাগ মোড়ের বিশেষায়িত হাসপাতালটি এখন পর্যন্ত তিনটি নাম পেয়েছে। সর্বশেষ অন্তর্বর্তী সরকার এটার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবর্তন করে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রেখেছে। তবে মানুষের কাছে এখনো এটা ‘পিজি হাসপাতাল’ নামে বেশি পরিচিত।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্বল্পোন্নত একটি দেশে রাজনৈতিক কারণে জনগণের টাকায় এ ধরনের ব্যয়বহুল নাম পরিবর্তন কেবল রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়ই নয়, বরং সামাজিক ও প্রশাসনিক অনিশ্চয়তাও বাড়াচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেন, শুধু একটি সড়কের নাম পরিবর্তন করলে ওই এলাকার হাজার হাজার মানুষের নথিপত্রে, ঠিকানায় সমস্যা তৈরি হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট সবকিছুতে সমস্যা হয়। জমির দলিল ও আইনি কাগজে পুরোনো নাম থাকায় আইনি জটিলতা তৈরি হয়। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। অন্যদিকে পরিবর্তিত নামটি রাষ্ট্রের সব স্তরে নতুন করে সংযোজন করতে, নথিপত্র পরিবর্তন করতে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। নামটি পরিচিত করে তুলতেও যুগ পার হয়ে যায়। হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, বিমানবন্দর, স্টেশন ইত্যাদি হঠাৎ নাম বদল হলে সাধারণ মানুষ জায়গা চিনতে অসুবিধায় পড়েন। এতে রাজনৈতিক বিভেদও বাড়ে। তাই রাজনৈতিক নামকরণ ও নাম পরিবর্তনের সংস্কৃতি থামা উচিত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম মহিউদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নামকরণ ও নাম পরিবর্তন সংস্কৃতি এই উপমহাদেশে বেশি। ইউরোপ-আমেরিকায়ও ব্যক্তির নামে স্থাপনা বা অবকাঠামোর নামকরণ হয়। তবে ব্যক্তির নামে নামকরণের ক্ষেত্রে তারা ওই ব্যক্তির রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক বা সামাজিক অবদান বিবেচনা করে। বাংলাদেশে সেটা হয় না। ক্ষমতায় আসলে কোনো অবদান না থাকলেও তার নামে প্রতিষ্ঠান হয়। এই কারণে সরকার বদলালে নাম বদলে যায়। এতে দেশ ও মানুষের ক্ষতি। এই কারণে নামকরণের জন্য জাতীয়ভাবে একটা নীতিমালা থাকা উচিত।