Image description

প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির খসড়া অধ্যাদেশ প্রকাশ করেছে সরকার। এর ওপর অংশীজনের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রীরা বলছেন, তাঁরা মন্ত্রণালয়ে কী মতামত পাঠাবেন, কীভাবে পাঠাবেন—সেগুলো তাদের শিক্ষকরা হাতে–কলমে শিখিয়ে দিচ্ছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিভাগগুলোর উদ্যোগে জুম মিটিং ডেকে আবার কিছু বিভাগে হাতে লিখে এসব শেখানো হচ্ছে।

ছাত্রীদের একাংশের অভিযোগ, শিক্ষকরা তাদের নিজস্ব মতামত ছাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রতিটি বিভাগে একাধিক জুম মিটিং কল করে শিক্ষকদের মতো করে মন্ত্রণালয়ে মতামত পাঠানোর জন্য মিটিংয়ে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। কিছু কিছু বিভাগে হাতে লিখেও শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে ছাত্রীরা নিজেদের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা করছেন।

ছাত্রীদের এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শিক্ষকরা। তারা বলছেন, খসড়া অধ্যাদেশের বেশ কিছু বিষয়ে তাদের আপত্তি রয়েছে। সেগুলো নিয়ে তারা ছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এ ছাড়া ছাত্রীরা মন্ত্রণালয়ে কীভাবে মতামত পাঠাতে পারেন, জুম মিটিংয়ে সে বিষয়ে গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকদের নিজস্ব মতামত চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। সবাই স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারছেন।

প্রত্যেক বিভাগে পৃথকভাবে জুম মিটিং আয়োজন করা হচ্ছে। এসব মিটিংয়ে শিক্ষকদের পছন্দমতো মতামত মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে ছাত্রীদের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। ফারহানা নামে একজন শিক্ষক একটি বিভাগের মেসেঞ্জার গ্রুপে জুম মিটিংয়ের লিংক দিয়ে লিখেছেন, ‘প্রিয় শিক্ষার্থীরা, আগামীকাল সন্ধ্যা ৭টায় জুম মিটিংয়ে জয়েন করার জন্য বলা হলো। মিটিংয়ের আইডি ও পাসওয়ার্ড উপরে দেওয়া হলো।’

জুম মিটিংগুলো সমন্বয় করছেন কলেজের বোটানি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মামুন মোরশেদ। তিনি বলেন, ‘খসড়া অধ্যাদেশ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অনেক ছাত্রী অধ্যাদেশ সম্পর্কে জানতো না। আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান স্টেকহোল্ডার। তাদের মতামত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খসড়া অধ্যাদেশ সম্পর্কে যারা জানেন না এবং জানলেও কীভাবে মতামত পাঠাতে পারেন, সে বিষয়ে জুমে তাদের ব্রিফ করা হয়েছে।’

এর আগে গত ২৪ সেপ্টেম্বর অংশীজনের মতামত চেয়ে প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির খসড়া অধ্যাদেশ প্রকাশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। খসড়া অধ্যাদেশ নিয়ে [email protected] ই-মেইল অথবা ‘সিনিয়র সহকারী সচিব, সরকারি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ১৭ তলা, ভবন নম্বর-০৬, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা’ বরাবর সাত কার্যদিবসের মধ্যে মতামত দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।

 

জানা গেছে, প্রত্যেক বিভাগে পৃথকভাবে জুম মিটিং আয়োজন করা হচ্ছে। এসব মিটিংয়ে শিক্ষকদের পছন্দমতো মতামত মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে ছাত্রীদের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। ফারহানা নামে একজন শিক্ষক একটি বিভাগের মেসেঞ্জার গ্রুপে জুম মিটিংয়ের লিংক দিয়ে লিখেছেন, ‘প্রিয় শিক্ষার্থীরা, আগামীকাল সন্ধ্যা ৭টায় জুম মিটিংয়ে জয়েন করার জন্য বলা হলো। মিটিংয়ের আইডি ও পাসওয়ার্ড উপরে দেওয়া হলো।’

শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্রীদের জুম মিটিংয়ের আলাপের বেশ কয়েকটি রেকর্ডিং দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস হাতে পেয়েছে। সেগুলোতে শিক্ষকদের বলতে শোনা যায়, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে যে মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে, সেখানে তাঁদের (শিক্ষকদের) চাওয়া অনুযায়ী কীভাবে ছাত্রীরা মতামত দিতে পারেন, সে বিষয়ে ধারণা দিতে এসব মিটিং আয়োজন করা হয়েছে।

এক নারী শিক্ষক মামুন নামে এক শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে মিটিংয়ে বলছেন, ছাত্রীদের যেন এ বিষয়ে ব্রিফ করা হয়। শিক্ষক মামুন তাঁর বক্তব্যের শুরুতে বলেন, ‘ওরা এখন একটা ছুটির মুডে রয়েছে। তাই হয়তো এটা নিয়ে সেভাবে গবেষণার সুযোগ পায়নি। তবে ওরা (ছাত্রীরা) জিনিসগুলো নিয়ে জানে...।’

অপর এক নারী শিক্ষক নিজের বক্তব্যে বলেন, ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির একটা খসড়া অধ্যাদেশ প্রকাশিত হয়েছে। এই বিষয়ে তোমাদের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। কীভাবে তোমরা মতামত দিতে পারো, সে বিষয়ে কথা বলার জন্য তোমাদের ডেকেছি।’

বক্তব্যের এক পর্যায়ে এ নারী শিক্ষক রাগান্বিত কণ্ঠে বলেন, ‘সেকেন্ড ইয়ারে তো তোমাদের ১০০-এর ওপরে স্টুডেন্ট। হোয়্যার আর ইউ অল? সবাই কোথায়?’ পরে তিনি ক্লাসের সিআরের খোঁজ করেন। বলেন, ‘তুমি আছো কেন?’ পরে তিনি জুম মিটিংয়ে উপস্থিত ছাত্রীদের বলেন, ‘যারা এখানে উপস্থিত হয়নি, তাদেরকে তোমরা শিক্ষকদের নির্দেশনাগুলো জানিয়ে দেবে।’

আরও পড়ুন: গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার ২০০’র বেশি সদস্যকে আটক করেছে ইসরায়েলি বাহিনী

শুধু জুম মিটিং নয়, কোনো কোনো বিভাগে সাদা কাগজে হাতে লিখেও শিক্ষকদের মতামতগুলো শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করা হচ্ছে। অপর একটি বিভাগের চ্যাট গ্রুপে আসমা নামে একজন শিক্ষক এমনই একটি লেখার ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘তোমরা এমন করে লিখে নাম, রোল, সেশন উপরের ই-মেইল দিয়ে পাঠাও।’ বিভাগটির পক্ষ থেকে চিঠির আদলে লেখা ওই নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অধ্যাদেশ-২০২৫ এর খসড়ার ওপর মতামত প্রেরণ।’

এতে আরও লেখা হয়, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অধ্যাদেশ-২০২৫ গভীরভাবে পর্যালোচনা করেছি। এ অধ্যাদেশে কিছু ছাত্র/ছাত্রীর মতের প্রতিফলন ঘটেছে।’ ‘আমার মতামত: ইডেন কলেজ ও বদরুন্নেসা কলেজে নারী–বান্ধব শিক্ষা বজায় রাখা; সাত কলেজকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা; কলেজের লোগো, স্থাবর–অস্থাবর সম্পত্তি কলেজের নামে অক্ষুণ্ণ রাখা; কোনো বিষয় বাদ দেওয়া যাবে না, বিশেষত আরবি ও ইসলাম শিক্ষা; ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি ভিন্ন স্থানে করা যেতে পারে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজের এক ছাত্রী বলেন, ‘পূজার ছুটির পর থেকে এসব জুম সেশন শুরু হয়েছে। প্রায় প্রতিটি বিভাগে ছাত্রীদের জুমে সেশন নেওয়া হয়েছে। কিছু বিভাগে হাতে লিখে শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জুম সেশনগুলোয় মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত খসড়া অধ্যাদেশ সম্পর্কে ছাত্রীদের ভুল বোঝানোর অপচেষ্টা হচ্ছে। ছাত্রীরা মন্ত্রণালয়ে কীভাবে শিক্ষকদের পছন্দের মতামত পাঠাবে, সেটা শেখানো হচ্ছে।’

এ ছাত্রীর ভাষ্য, ‘শিক্ষকদের নিজেদের ইচ্ছা এক প্রকার আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য ট্রমার মতো। প্রকাশ্যে বলতে না পারলেও তাদের এসব কথা বেশিরভাগ ছাত্রী শুনছেন না। তারা নিজেদের মতো করে মতামত পাঠাচ্ছেন। শিক্ষকদের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে অন্য ছাত্রীদের মাঝে চাপা ক্ষোভও বিরাজ করছে।’

মতামত পাঠানো নিয়ে ছাত্রীদের অভিযোগের বিষয়টি অধ্যাপক মামুনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা প্রচণ্ড ক্ষমতাবান। তাদের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায় না। আর তারা সবাই অনার্স–মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। সবাই নিজেদের অধিকার বোঝেন। হাতে লিখে হয়তো তাদের একটা ডামি ফরম্যাট দেখানো হতে পারে। জুমেও মতামত পাঠানোর পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। শিক্ষকদের কোনো মত চাপিয়ে দেওয়া হয়নি।’

তার দাবি, ‘যারা এমন অভিযোগ করেন, আপনি দেখবেন তাদের ক্লাসে উপস্থিতি নেই। অনেকে পরীক্ষাতেও নিয়মিত নয়। যারা পড়ালেখায় অনিয়মিত, তারাই এমন অবান্তর অভিযোগ তুলে বিশৃঙ্খলার অপচেষ্টা করেন।’

এদিকে ইডেন কলেজের অপর একটি অংশের শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে মন্ত্রণালয়ের খসড়া অধ্যাদেশ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা ইডেন মহিলা কলেজে যেকোনো ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রম চালুর বিপক্ষে মত দেন। তাদের দাবি, ইডেন কলেজে সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু হলে নারী শিক্ষার সুযোগ সংকুচিত হবে, যা তারা চান না। তারা প্রকাশিত খসড়া অধ্যাদেশ বাতিল করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল অনুসরণের আহবান জানান। 

ছাত্রীদের এ সংবাদ সম্মেলন নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। শিক্ষকদের প্ররোচনায় কিছু অতি উৎসাহী ছাত্রী এ কর্মসূচি করেছেন বলে অপর একটি পক্ষের ছাত্রীদের অভিযোগ। তাদের দাবি, খোদ কলেজের শিক্ষকরা ছাত্রীদের এ কর্মসূচির প্রচারণা চালিয়েছেন। ছাত্রীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে ও ভয়–ভীতি দেখিয়ে কর্মসূচিতে নিয়েছেন। ক্লাসের সিআরদেরও এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। ছুটির পরও যেসব ছাত্রী ঢাকায় থেকে গেছেন, তাদের এ কর্মসূচিতে আসার জন্য সিআরের মাধ্যমে শিক্ষকরা নির্দেশনা দিয়েছেন।

সাইকোলজি বিভাগের এক ছাত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকার জন্য সাংবাদিকদের যে আমন্ত্রণপত্র দেওয়া হয়েছে, সেটির ছবি রোজি ম্যাডাম (বিভাগের শিক্ষক) আমাদের বিভাগের চ্যাট গ্রুপে দিয়ে সব ছাত্রীকে উপস্থিত থাকার জন্য বলেছেন। তিনি ওই ছবি দিয়ে গ্রুপে লিখেছেন, ‘কফিনে শেষ পেরেক পড়ার আগে সকলে মিলে একবার শেষ চেষ্টা করতে পারেন।’

যদিও প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত বাস্তবায়নের পক্ষেও শক্ত অবস্থানে আছেন অনেকে। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ প্রক্রিয়া আর সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করেই বিশ্ববিদ্যালয়টির খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে কোনো বিষয়ে আপত্তি থাকলে মতামতের সুযোগ রয়েছে।

শিক্ষকরাও বিষয়টির একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান চান দাবি করে অধ্যাপক মামুন বলেন, ‘আমরা কেউই ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে না। তবে যে খসড়া প্রকাশ হয়েছে, সেটা নিয়ে এখন একটা গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ খসড়া নিয়ে শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের কিছু আপত্তি আছে। আমরা চাই, সেগুলোই সংশোধন করা হোক।’

তিনি আরও বলেন, ‘কলেজের স্বকীয়তা রক্ষা করে, ঐতিহ্য রক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয় হলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এখন শিক্ষক–শিক্ষার্থী সবাই মতামত দিচ্ছেন। আশা করি, সরকার সব পক্ষের জন্য গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নেবে।’