Image description

শেখ হাসিনার নির্দেশে সংঘটিত জুলাই গণহত্যার অন্যতম মাস্টার মাইন্ড ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ অর্ধশতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা এখন কলকাতায় নিরাপদ আশ্রয়ে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখতে গুম, খুন, নির্যাতন, বিরোধী দল দমন-পীড়নসহ নানা ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত এসব পুলিশ কর্মকর্তা জুলাই বিপ্লবের পর ভারতে পালিয়ে গেছেন। হাবিবুর রহমানের পাশাপাশি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়, ডিআইজি আনিসুর রহমান, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান, বহুল আলোচিত অতিরিক্ত ডিআইজি ‘র’-এর এজেন্ট প্রলয় কুমার জোয়ার্দারসহ অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তা এখন কলকাতায় ঘাঁটি গেড়ে বসেছেন। বর্তমানে তারা ভারতের ডিপ এস্টেটের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য নানামুখী পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন বলে নিরাপত্তা সূত্রগুলো আমার দেশকে জানিয়েছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি দেশ ছেড়ে পালিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছেন শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত বেশ ক’জন আমলা ও সরকারি আইনজীবী। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সচিব মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের মতো শীর্ষ আমলারাও দেশ ছেড়ে পালিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছেন।

 

বাংলাদেশ থেকে জুলাই বিপ্লবের পর যেসব আওয়ামী লীগ নেতা, আমলা, পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তা এবং অন্যান্য পদস্থ কর্তাব্যক্তি কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের বিস্তারিত তথ্য সংবলিত একটি ডেটাবেস তৈরি করছে ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)। গত ১০ আগস্ট পর্যন্ত ডেটাবেসে ৭৩৪ জনের বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। ওই তালিকায় ৫০ জনেরও বেশি পুলিশ কর্মকর্তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ডেটাবেসে সংরক্ষিত এসব পুলিশ কর্মকর্তার পাশাপাশি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির যাবতীয় তথ্য এখন আমার দেশ-এর হাতে।

আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের অন্যতম কারিগর সাবেক নির্বাচন কমিশনার আনিসুর রহমান দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি তার স্ত্রী সালমা সুলতানাকে নিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট ১০২, গুলমহর, ৬০ মিডল্টন স্ট্রিট, কানকারিয়া এস্টেট, কলকাতাÑএই ঠিকানায় বসবাস করছেন। তার বর্তমান বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর ডি-০০০১১৮৪১। তার ফোন নম্বর +৯১৯১৬৩৭৮৮৯৮০। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখা এবং ডামি নির্বাচন অনুষ্ঠানের আরেক কারিগর সাবেক মুখ্য সচিব মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এখন কলকাতা সদরে অবস্থান করছেন। তিনি মুখ্য সচিবের আগে শেখ হাসিনার পিএস-১ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তার কাছে থাকা বর্তমান বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর ডিসি-৪০০৭৫৪১। তার ব্যবহৃত ফোন নম্বর +৯১৮৪১৩৯৯৯২৩৫।

চব্বিশের ডামি ভোটের ৬ মাস আগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োপ্রাপ্ত তোফাজ্জল হোসেন নির্বাচনে ‘বিশেষ ভূমিকা’ পালনের পুরষ্কারসরূপ শেখ হাসিনা তার চুক্তির মেয়াদ আরো এক বছর বৃদ্ধি করে। কোটা সংস্কার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী হিসেবে তিনি নীতিনির্ধারণী ভূমিকা পালন করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পর গত বছরের ৭ আগষ্ট মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে সরকার।

শেখ হাসিনার সাবেক সচিব মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন এখন কলকাতা সদরে অবস্থান করছেন। এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-১ ও ঢাকার ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৫ আগস্টের পর পাল্টা ক্যু করতে বেশ কয়েকজন আমলাদের নিয়ে তিনি গোপন বৈঠক করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সুবিধা করতে না পারায় ভারতে পালিনে যান। তার কাছে থাকা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর ডি-০০০১৩৪৭০। তার কলকাতার ফোন নম্বর +৯১৬৯০৯২২৫১০৬।

বহুল আলোচিত দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল এখন কলকাতার অভিজাত এলাকা ১৩৩০/৫ ইই ব্লক, সল্ট লেক, কলকাতাÑএই ঠিকানায় থাকছেন। কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি এবং অর্থপাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত পিলখানা হত্যা মামলার এই সরকারি আইনজীবীর কাছে থাকা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর এ-১৫৭২৮৩৫২। তার ব্যবহৃত ফোন নম্বর ০১৭১১৫২২৭০৮।

শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সাবেক সচিব মো. রাশিদুল আলম ৫ আগস্টের পর সস্ত্রীক দেশ থেকে পালিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের বড় ভাই। তিনি আওয়ামী লীগকে নির্বাচনী বৈতরনী পার করার ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি প্রথমে এইচটি ইমামের সেকেন্ডম্যান হিসেবে কাজ করলেও তার মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের নির্বাচন সংক্রান্ত মুল দায়িত্ব পালন করতেন সাবেক এই আমলা। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য রাশিদুল আলম দলের নির্বাচনী বোর্ডেও সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার কাছে থাকা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর এ-০০১৩১২৮৪। তার বর্তমান ফোন নম্বর +৬০১৮৯৭৬০৪৯৩। সাবেক এই আমলা বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতির সভাপতি।

জুলাই গণহত্যার অন্যতম প্রধান হোতা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান তার স্ত্রী সামসুন্নাহার এবং ছেলে আফতান আফিফ আব্দুল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। তিনি এখন কলকাতা সদরে অবস্থান করছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, হাবিবুর রহমান কলকাতায় বসে ভারতের ডিপ স্টেটের সঙ্গে মিলে নানা ধরনের বাংলাদেশবিরোধী তৎপতায় লিপ্ত। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের পাশাপাশি নাশকতার মাধ্যমে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন তিনি। জুলাই গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। খুনি এই সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার কাছে থাকা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর ই-০০০০৯৭৯২। কলকাতায় তার ব্যবহৃত ফোন নম্বর +১ (৭১৮) ৭৫৫৪২৫৫।

কোলকাতায় অবস্থানকারী অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন সিএমপির সাবেক কমিশনার (অতিরিক্ত আইজি) কৃষ্ণপদ রায়, পাসপোর্ট নম্বর ই০০১৫৩৭১৯, মোবাইল নম্বর +৯১৮৫৮২৮৪৬৮০৮; ডিআইজি মো: আনিসুর রহমান, পাসপোর্ট নম্বর ই০০১৫৩৯৪৪, মোবাইল নম্বর +৯১৮০১১৪৮৯৩৭০; রংপুর রেঞ্জের সাবেক কমিশনার ডিআইজি মনিরুজ্জামান, পাসপোর্ট নম্বর এ১৮১৭২৩৩২, মোবাইল নম্বর +৬৬৯৩৩২৫১২৪; অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, পাসপোর্ট নম্বর ই০০১২৬৯৭, মোবাইল নম্বর +৮৮০১৮১৯২৭৫৫৫; অতিরিক্ত ডিআইজি সুদীপ কুমার চক্রবর্তী পাসপোর্ট নম্বর ই০০১৪০৯২৫, মোবাইল নম্বর +৯১৮৮৭৬৬৮০১৫ এবং অতিরিক্ত ডিআইজি রিফাত রহমান শামীম, পাসপোর্ট নম্বর বিজি০০৩৭৬২৬, মোবাইল নম্বর +৮৮০১৮৭৪৫৫০৫।

এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্যে পালিয়ে যারা ভারতে অবস্থান করছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- আসাদুজ্জামান, পাসপোর্ট নম্বর ই০০১৩১০০৮, মোবাইল নম্বর +৮৮০১৭১৬০৬৪৩৩৮; গোলাম মোস্তফা রাসেল তার পাসপোর্ট নম্বর ই০০০৫০২২৭, মোবাইল নম্বর +৬৫৮৪৬৪৭৫৯২; মো: শাহজাহান পাসপোর্ট নম্বর ই০০১৫৭৬৫৬, মোবাইল নম্বর +৪৪৭৯৪৭৩২৬১৮০, আরিফুর রহমান মন্ডল, মুহম্মদ সানোয়ার হোসেন এবং হাসান আরাফাত।

অতিরিক্ত এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন মো. মাসুদুর রহমান, এস এম শামীম, শাহনূর আলম পাটোয়ারী, হাসানুজ্জামান মোল্লা, শাহ আলম মো. আক্তারুল, রাজন কুমার দাস, মো: রাশেদুল ইসলাম ও এডিসি ইফতেখারুল ইসলাম। কোলকাতায় রয়েছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর ভাই সহকারী পুলিশ সুপার গোলাম রুহানী ও এএসপি মুহম্মদ ইমরুল। এছাড়া পুলিশের পরিদর্শকদের মধ্যে জাকির হোসেন, মো. ওবায়দুল হক মামুন, কাজী মঈনুল ইসলাম, অপূর্ব হাসান, মোহাম্মদ মহসিন, শামসুল হক, তানভীর আহমেদ, আশীষ কুমার দেব, ও মো. মশিউর রহমান। উপ পরিদর্শক তরিকুল ইসলাম ভূইঁয়া, মোহাম্মদ সোহেল ও শেখ মো: জাবেদ মিয়া এখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে কোলকাতায় অবস্থান করছেন। পলাতক এসব কর্মকর্তাদের বেশিরভাগকে সরকার সাময়িক বরখাস্ত করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। এদিকে কৃষ্ণপদসহ কয়েকজনকে ৫ আগস্টের পরে বাধ্যতামুলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।

বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ও ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনও পালিয়ে গিয়ে বর্তমানে কোলকাতায় অবস্থান করছেন।