
জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাতারাতি ভেঙে পড়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি । একদিকে মব সৃষ্টি , মাজার ভাঙা , ছিনতাই - চাঁদাবাজির মতো অপরাধ বেড়ে যাওয়া , অন্যদিকে মনোবল ভেঙে পড়া পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা — সব মিলিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার । এমন অবস্থায় আগামী বছরের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা রয়েছে । বিশ্লেষকদের আশঙ্কা , নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে ।
পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে এক মারমা কিশোরীকে ধর্ষণের জেরে বিক্ষোভ , অবরোধ , আগুন ও হামলায় তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে । এ ধরনের সহিংসতার জন্য পাহাড়ি সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে ( ইউপিডিএফ ) দায়ী করেছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর ( আইএসপিআর ) ।
অন্যদিকে পাহাড়ে সহিংসতার পেছনে প্রতিবেশী দেশের ইন্ধন রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল ( অব . ) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী । খাগড়াছড়ির চলমান পরিস্থিতি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এমন মন্তব্য পাহাড় অশান্ত হয়ে ওঠার ইঙ্গিত বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা । শুধু পাহাড় নয় , সমতলের আইনশৃঙ্খলাও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেই । জুলাই অভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতির অবনতির অন্যতম কারণ রাজনৈতিক সহিংসতা , যা নির্বাচন সামনে রেখে আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে । পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী , চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে ২ হাজার ৬১৩ জন খুন হয়েছে ।
অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ( আসক ) তথ্যমতে , ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের গত আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৫১১ টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে । এতে ১৩৫ জন নিহত ও ৫ হাজার ৭৭৫ জন আহত হয়েছে । এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৯৪ জন নিহত ও ৪ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে । আর প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হয়েছে ৪১ জন । আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে , জাতীয় নির্বাচনের আগে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা - কর্মীরা নিজেদের মধ্যে কোন্দলে জড়াতে পারেন । এ ছাড়া নির্বাচনী এলাকাগুলোতেও বিভিন্ন দল বা জোটের প্রার্থীদের মধ্যেও সংঘাত - সংঘর্ষ হতে পারে । তৃতীয় কোনো শক্তিও নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর মতো পদক্ষেপ নিতে পারে । অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগও নির্বাচন বানচাল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে থাকবে বলে তথ্য পাচ্ছে তারা ।
পরিসংখ্যান বলছে , গত এক বছরে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের মধ্যে ৩৪৭ টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে । এই সময়ে বিএনপি নেতা - কর্মীদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংঘর্ষে ৮৩ জন নিহত এবং চার হাজার নেতা - কর্মী আহত হয়েছেন । একই সময়ে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের মধ্যে ১৮ টি সহিংস ঘটনায় ১১ জন নিহত হয়েছেন । জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন তিনজন । এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির ( এনসিপি ) অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে অন্তত ১০ টি সহিংসতার ঘটনায় ৬৬ জন আহত হয়েছেন । বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব সংঘাত - সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বলে দলীয় নেতা - কর্মীরা জানিয়েছেন । রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবেই সহিংসতা ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ।
তিনি বলেন , দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব থেকেই সহিংসতা বাড়ছে । নেতৃত্ব ধরে রাখতে পেশিশক্তির প্রয়োগ এখন রাজনৈতিক নিয়মে পরিণত হয়েছে । দল ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে এ সহিংসতা কমবে না , বরং ভোটের আগে আরও বাড়তে পারে । এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে সব বাহিনী সমন্বিতভাবে কাজ করছে । স্থানীয় নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করে পরিস্থিতি উন্নয়নে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর । র্যাবের মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন , বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ । নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করতে সব বাহিনী সমন্বিতভাবে কাজ করছে ।
আর পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ( ক্রাইম অ্যান্ড অপস ) খন্দকার রফিকুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন , সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আলাদা কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি । তবে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে স্থানীয় নাগরিক সমাজের আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি উন্নয়নে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । গত বছরের ৫ আগস্টের পর একধরনের আইন অমান্যের অবস্থা তৈরি হয়েছিল । মানুষকে সম্পৃক্ত না করলে ভবিষ্যতে সামাল দেওয়া আরও কঠিন হয়ে যাবে ।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর গত আগস্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলায় গুরুতর আহত হন । ওই দিন জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে দুই দফায় দুই দলের নেতা - কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় । সে সময় বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছিলেন , নির্বাচন ব্যাহত করতে পরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থির করার চেষ্টা চলছে । এসব বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন , ‘ বিএনপি সহিংসতার ঘটনায় জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলে । নেতা- কর্মীদের সংযম ও শান্তি বজায় রাখতে আহ্বান জানানো হয়েছে । তবুও যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে , তার জন্য আমরা দুঃখিত ও বিব্রত । দায়ীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে । '
আর এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহবায়ক সামান্তা শারমিন বলেন , ‘ বিএনপি বা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতি শক্তি প্রদর্শনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে । হুট করে সেটা পরিবর্তন সম্ভব নয় । আমরা সেই ধারা থেকে বের হয়ে আসতে চাই । ' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন , ‘ সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিতে পারেনি । নির্বাচন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত । অনেকে বলছেন , নির্বাচন ঠেকাতে ইচ্ছাকৃতভাবে আইনশৃঙ্খলার অবনতির চেষ্টা চলছে , যা ভবিষ্যতে আরও গুরুতর আকার নিতে পারে । '