
২০০৯ থেকে ২০২৪—এই ১৫ বছরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে নেওয়া হয়েছে অন্তত ৮২টি উন্নয়ন প্রকল্প। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু বিপুল এই বিনিয়োগের একটি বড় অংশ এখন কার্যকারিতা হারিয়েছে—অফিস আছে, কাজ নেই; ভবন আছে, মানুষ নেই। কোথাও আবার প্রকল্পের বাস্তব প্রয়োজনই ছিল না।
পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল ও শেখ রেহানার নামে ৮২টি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮টির বাস্তবায়ন শেষ হলেও ৪৪টি এখনো চলমান।
এই প্রকল্পগুলো শিক্ষা, তথ্য-প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, পরিবেশ, ক্রীড়া, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে ছড়িয়ে রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে শিক্ষা খাতে—বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ স্থাপন বিষয়ে।
১২টি প্রকল্পে শেখ হাসিনা বা শেখ মুজিবের নাম রয়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তি খাতে ১১টি, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে আটটি, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে সাতটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগে ছয়টি প্রকল্পে শেখ পরিবারের সদস্যদের নাম যুক্ত হয়েছে।
তবে বাস্তবায়নের পর দেখা যাচ্ছে, এই প্রকল্পগুলোর বড় অংশই এখন অচল বা নিম্নমাত্রায় কার্যকর। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোও স্বীকার করছে, লোকবল, দক্ষতা কিংবা আর্থিক সক্ষমতার ঘাটতির কারণে প্রকল্পগুলো টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
একেকটি ভবন, একেকটি ব্যর্থতার চিত্র : যশোরে ৩০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক এখন বিয়ের অনুষ্ঠান, বাণিজ্যিক মেলা ও সামাজিক আয়োজনে ভাড়া দেওয়া হয়। অথচ এই পার্কের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল তথ্য-প্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থান ও রপ্তানি বাড়ানো।
এমন চিত্র সিলেটের বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কেও। এখানে জমি বরাদ্দ পেয়েছে ক্লাব, রেস্তোরাঁ ও হাসপাতাল। তথ্য-প্রযুক্তি উদ্যোক্তা উন্নয়নের কার্যক্রম নেই বললেই চলে।
চট্টগ্রামের চুয়েট ক্যাম্পাসে শেখ কামাল আইটি ইনকিউবেটর, ব্যয় ১১৭ কোটি টাকা—উদ্ভাবনী উদ্যোগের কেন্দ্র হওয়ার কথা ছিল, এখন খালি ভবনে পরিণত হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালকও স্বীকার করেছেন, পর্যাপ্ত সমন্বয় ও পরিকল্পনার অভাবে এটি কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে না।
জামালপুরে নেওয়া হয়েছিল তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকার শেখ হাসিনা নকশীপল্লী প্রকল্প। পরিকল্পনার শুরুতেই অনেক কর্মকর্তা মত দিয়েছিলেন, এত বড় পরিসরে এর প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নাম থাকায় আপত্তি উপেক্ষা করে অনুমোদন দেওয়া হয়। অন্তর্বর্তী সরকার এসে ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণের অংশটি বাদ দেয়।
তদবিরেই প্রকল্প অনুমোদন : অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধিকাংশ প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে রাজনৈতিক তদবিরে। ময়মনসিংহের তারাকান্দায় ৪৮ কোটি টাকার ‘বঙ্গবন্ধু সামাজিক বিনোদন পার্ক’ প্রকল্প পাস হয় তৎকালীন গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের চাপেই। স্থানীয় প্রকৌশলীরা এটি অপ্রয়োজনীয় উল্লেখ করে পাঠিয়েছিলেন। মৌলভীবাজারের লাঠিটিলায় পরিবেশ সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ৩৬৪ কোটি টাকার ‘বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক’ প্রকল্প নেওয়া হয় সাবেক পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের নির্বাচনী এলাকায়। বন বিভাগের আপত্তি সত্ত্বেও প্রকল্পটি নির্বাচনের আগে অনুমোদন পায়। এখন সেটি বাতিলের প্রক্রিয়ায়। আরেকটি প্রকল্প, রাজশাহীর তালাইমারীতে ৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু স্কয়ার’। স্থানীয়ভাবে এটি অগ্রাধিকার প্রকল্প নয় বলেই মত দিয়েছেন অনেকে। তবু রাজনৈতিক তদবির ও ‘নামের জোরে’ একনেকে পাস হয়।
প্রশ্ন তোলার সাহস ছিল না সচিবদেরও : পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক এক সচিব বলেন, ‘আমরা জানতাম কিছু প্রকল্প অস্বাভাবিক ব্যয়ে নেওয়া হচ্ছে, প্রয়োজনও নেই। কিন্তু শেখ পরিবারের সদস্যদের নাম থাকলে কেউ প্রশ্ন তোলার সাহস করত না। এমনকি যন্ত্রপাতি কেনা নিয়ে কোনো জবাবদিহিও থাকত না।’ আরেক সাবেক সচিব বলেন, শিক্ষা ও আইসিটি খাতে প্রকল্প আনার অন্যতম কৌশল ছিল প্রধানমন্ত্রীর নাম জুড়ে দেওয়া। এতে বাজেটও বাড়ত, সমালোচনার পথও রুদ্ধ হতো।
প্রধানমন্ত্রীর বিরক্তি, তবু থামেনি নামের ব্যবহার : ২০২৪ সালের মে মাসে একনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর নামে যেন আর কোনো প্রকল্প নেওয়া না হয়। কিন্তু তত দিনে ৪৩টি নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব জমা পড়ে, যার সবকটিতেই শেখ পরিবারের সদস্যদের নাম জুড়ে দেওয়া হয়।
বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার এসব প্রকল্প পর্যালোচনা করছে। শেখ পরিবারের নামে থাকা প্রকল্পগুলোর নাম পরিবর্তনের পাশাপাশি যাচাই করা হচ্ছে প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয়তা। প্রয়োজন না থাকলে সেগুলো অসমাপ্ত রেখেই সমাপ্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।
প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও প্রতীকী রাজনীতি : ‘শেখ’ নামে সবচেয়ে বেশি প্রকল্প অনুমোদন পাওয়া পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) আব্দুর রউফ বলেন, ‘শেখ’ নামে থাকা অধিকাংশ প্রকল্পেরই নাম পরিবর্তন করা হচ্ছে। যেসব প্রকল্প একেবারে আমাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে বা যেসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন হার একেবারে কম, সেগুলো অসমাপ্ত রেখেই সমাপ্ত করা হচ্ছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘নাম ব্যবহার করে প্রকল্প নিলে কেউ জবাবদিহির মুখে পড়ত না। এতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর পরিবারতন্ত্র ঘনীভূত হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের পেছনে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তার উৎসও এখানেই।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরি কালের কণ্ঠকে বলেন, বিগত সরকারের আমলে নেওয়া প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগই পড়ে আছে। সেই প্রকল্পগুলো তিনভাবে দেখা উচিত—যেগুলো শেষ হয়ে গেছে সেগুলো অন্য কাজে ব্যবহার করতে হবে; চলমানগুলো খতিয়ে দেখে রি-ডিজাইন করতে হবে, আর যেগুলো শুরু হয়নি সেগুলো মূল্যায়ন করে প্রয়োজন না হলে বাদ দিতে হবে।
মুস্তফা কে মুজেরি আরো বলেন, যেসব কর্মকর্তা ও মহল এসব প্রকল্প আনার মাধ্যমে দুর্নীতি করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। ভবিষ্যতে যেন এমন অপচয় আর না হয়।