Image description

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সমীর মণ্ডল ও তার স্ত্রী জয়ন্তী বিশ্বাস বিয়ের ৯ বছর পর প্রথম সন্তানের সুখ লাভ করেন। শিশুটির নাম রাখেন প্রতিভা। এই দম্পতির স্বপ্ন ছিল তাদের মেয়ে বড় হয়ে একজন চিকিৎসক হবে। তবে সেই স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে একদিনের ব্যবধানে ঢাকায় তার স্ত্রী ও মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। স্ত্রী’র মরদেহ সমাহিত করে আসার পরদিন জানতে পারেন তার সন্তানও মারা গেছে। পরে মায়ের পাশেই সমাহিত করা হয় প্রতিভাকে।  

ডেঙ্গু পরিস্থিতি বেশ অবনতির দিকে আছে। চলতি বছর এখনও পর্যন্ত ৪৫ হাজার ২০৬ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া এ বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১৮৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন, মে’তে ১ হাজার ৭৭৩ জন , জুনে ৫ হাজার ৯৫১ জন, জুলাইয়ে ১০ হাজার ৬৮৪ জন এবং আগস্টে ১০ হাজার ৪৯৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। এদের মধ্যে জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, এপ্রিলে ৭ জন, মে’তে ৩ জন, জুনে ১৯ জন, জুলাইয়ে ৪১ জন, আগস্টে ৩৯ জন এবং সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখ পর্যন্ত ৬৬ জন মারা গেছেন। 

ডেঙ্গু রোগীর পরিসংখ্যান থাকলেও চিকুনগুনিয়ার পরিসংখ্যান সেভাবে কারও জানা নেই। গত জুন মাসের ২১ তারিখ পর্যন্ত আইসিডিডিআর,বি’র ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরিজের বিভিন্ন শাখায় জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ নিয়ে মানুষ এসেছেন। তাদের মধ্যে ১৭১ জন রোগীর আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করা হয়। সেখানে ১৪০ জনের চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়, যা শনাক্তের হিসাবে প্রায় ৮২ শতাংশ। এই হার গত বছরের তুলনায় উদ্বেগজনক বলে মনে করে আইসিডিডিআর,বি।

চলতি বছর ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ আক্রান্তের জেলা হচ্ছে বরিশাল বিভাগ। এই বিভাগে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৯২৮ জনে। এরপরেই আক্রান্তের দিক দিয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী রয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায়। ঢাকা উত্তর সিটিতে ৫ হাজার ৩৪ জন এবং দক্ষিণ সিটিতে ৬ হাজার ৯২৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। পাশাপাশি চট্টগ্রামে ৬ হাজার ৯২৬ জন এবং ঢাকা বিভাগে ৬ হাজার ৬৭৫ জন রোগী পাওয়া গেছে।

মৃত্যুর পরিসংখ্যান বলছে, সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায়। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় এ বছর ৯০ জন মারা গেছেন। পাশাপাশি ঢাকা উত্তর সিটিতে ২৪ জন, বরিশালে ২৮ জন, চট্টগ্রামে ২৩ জন, ঢাকা বিভাগে ২ জন, খুলনা বিভাগে ৫ জন, ময়মনসিংহে ৬ জন এবং রাজশাহীতে ১০ জন ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। তবে রংপুর এবং সিলেট বিভাগে এ বছর এখনও পর্যন্ত ডেঙ্গুতে কোনও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আগস্ট মাসের পূর্বাভাস-প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্টে টানা বৃষ্টি হওয়ায় ও বিগত বছরের অভিজ্ঞতা অনুসারে সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে পারে। এতে হাসপাতালগুলোতে ভর্তির চাপও বাড়তে পারে। তবে অক্টোবরে বর্ষা শেষে সংক্রমণ কমার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও দ্বিতীয় দফায় প্রাদুর্ভাব চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। এ সময়ও লার্ভিসাইডিং ও স্যানিটেশন কার্যক্রম জোরদার রাখার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ম্যালেরিয়ার মতো পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সম্মিলিতভাবে সব সংস্থাকে একটি ইউনিটের মাধ্যমে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘কোনও একটা সংস্থা বা হাসপাতালের পক্ষে একা রোগী নিয়ন্ত্রণ বা মশা নিধন করা সম্ভব নয়। প্রতি বছরই তো একইভাবে চলছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট করা উচিত আইইডিসিআরের মতো, যারা সমন্বয় করে কাজ করবে।’’

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘‘তথ্যগত সমস্যা থাকলেও রোগটি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য পরিষেবা এখনও যথাযথ নয়। ডেঙ্গু রোগে রাজধানী এবং এর বাইরের সুযোগ-সুবিধার বিস্তর ব্যবধান আছে। আমরা মশা নিয়ন্ত্রণে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে যেমন পারিনি, তেমনই প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবায় ডেঙ্গুকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। এর ধারাবাহিকতা চলছেই।’’

স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, শেষ মুহূর্তে রোগী হাসপাতালে আসায় বাঁচানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, ‘‘১১৪ মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ৫৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তির প্রথম দিনই মারা যান। বেশিরভাগ মৃত্যুর কারণ হলো— ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং হাসপাতালে পৌঁছাতে দেরি হওয়া।’’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (সিডিসি) শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মো. হালিমুর রশীদ জানান, ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালে। ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী রোগী বেশি মারা যাচ্ছেন। রোগীরা তিন থেকে ছয় দিন ধরে জ্বরে ভোগার পর হাসপাতালে আসছেন। মারা যাওয়া ৯০ জন রোগী মধ্যে ৩৯ জনই দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছিলেন।

তিনি জানান, ১১৩ রোগীর তথ্যে জানা যায়, ৫৬ জন ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে মারা গেছেন, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম। এতে মারা যান ৩৬ জন। উভয় সমস্যা ছিল ৯ জনের, এ ছাড়া ডেঙ্গুর সঙ্গে কার্ডিয়াক শকে মারা যান ৯ জন।

ডা. মো. হালিমুর রশীদ বলেন, ‘‘মারা যাওয়া ১১৪ জন রোগীর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ৬৬ জন মারা গেছেন হাসপাতালে ভর্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। এরপর ৭২ ঘণ্টা পর ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১৮ জন মারা গেছেন ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে। পাঁচজন মারা গেছেন ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে।’’

চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত বিশ্বের ১৭৫টি দেশের ডেঙ্গু সংক্রমণের তথ্য প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সেখানে বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার দেখানো হয়েছে ০.৫২ শতাংশ, যা সর্বোচ্চ। এ তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, সেখানে মৃত্যুহার ০.৪১ শতাংশ। আক্রান্তের সংখ্যায় দেশটির অবস্থান সপ্তম হলেও মৃত্যুহারে এটি এখন এক নম্বরে।