
বরুড়া কুমিল্লা জেলার নির্বাচনী আসন-৮। জেলা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই আসনে সর্বত্র ভোটের আলোচনা। মাঠে, বাজারে সব জায়গায় সাধারণ মানুষ ভোট নিয়ে আলোচনা করছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা চষে বেড়াচ্ছেন মাঠে-ঘাটে। চলছে প্রচার-প্রচারণা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মাঠছাড়া আওয়ামী লীগের ভোটারদের নিয়ে এখানে নানা আলোচনা। এই ভোট নিয়ে মাঠে নতুন সমীকরণ। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই কৌশল নিচ্ছেন বিএনপি, জামায়াত ও অন্য দলের প্রার্থীরা। গত কয়েকদিন সরজমিন ঘুরে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
এই আসনে বিএনপি’র হয়ে লড়তে যাচ্ছেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সভাপতি জাকারিয়া তাহের সুমন। তিনি সাবেক সংসদ সদস্য, শিল্পপতি ও ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম এ কে এম আবু তাহেরের বড় ছেলে। কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক নেতা মোরতাজুল করিম বাদরুও আছেন আলোচনায়।
অন্যদিকে, জামায়াতের পক্ষ থেকে লড়াইয়ে নামছেন অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম হেলাল। এ ছাড়া আরও কয়েকজন প্রার্থী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সরজমিন স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বরুড়ার খোসবাস, আগানগর ও গালিমপুরসহ কয়েকটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী ভোট ব্যাংক রয়েছে। তাদের মতে, আওয়ামী লীগের ভোটই এখানে মূল ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে। যে দল এই ভোটগুলোকে কোর্টে নিতে পারবে, তারাই জয়ের পাল্লা ভারী করবে।
এদিকে, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ভোটারদের বক্তব্যেও ফুটে উঠছে নানা গল্প।
তবে তরুণ ভোটারদের ভাবনা ভিন্ন। বয়স্করা পিআর না বুঝলেও কলেজ-ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ‘প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন’ (পিআর) পদ্ধতি কেউ কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আগানগর ডিগ্রি কলেজ থেকে মাইল তিনেক উত্তরে গোহিনখালি গ্রাম। সরু পথ জুড়ে ইটের সলিং বিছানো। রাস্তার দু’ধারে ফসলি জমি। চোখ জুড়ানো গ্রামটিতে যতদূর চোখ যায় শুধু ধান ক্ষেত। এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সড়ক ধরে প্রায় ৩ কিলো হাঁটার পর সড়কের পাশে একটি টং দোকানের দেখা মেলে। বয়োবৃদ্ধ সগির আহমেদ দোকানটি চালান। গ্রামের কৃষকরা সারাদিন খাটুনি শেষের শরীরকে একটু প্রশান্তি দিতে টং দোকানটিতে আড্ডা দেন, চা-সিগারেটে ক্লান্তি ঝাড়েন। শাকপুর এলাকার ষাটোর্ধ্ব আখমত আলী বলেন, গত ১৪, ১৮, ২৪ সালের ভোট দিতে পারিনি। কেন্দ্রে গিয়ে দেখি ভোট হয়ে গেছে। এবার যেভাবেই হোক ভোট দেবো। পিআর-টিআর বুঝি না, শুধু চাই সঠিকভাবে ভোট দিতে।
দোকানটি থেকে আরেকটু সামনে হাঁটতেই সামনে পরে শাহপুর। কয়েকজন মানুষ দোকানে বসে টিভি দেখছেন। এ এলাকার কৃষক রাসেল হোসেন বলেন, টিভিতে পিআর নিয়ে আলোচনা দেখি, কিন্তু কীভাবে কাজ করে জানি না। আমরা চাই সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে। পিআর যদি দেশের জন্য ভালো হয় তাহলে তা আসুক, না হলে বিশেষজ্ঞরা সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা আমজনতা এতকিছু বুঝি না।
খোসবাস ইউনিয়ন এলাকার বাসিন্দা নজির আহমেদ বলেন, আমরা চাই সুষ্ঠু ভোট। পড়ালেখা করি নাই তাই পিআর নিয়ে বিস্তর জ্ঞান নাই। এতটুকুই বুঝি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যেন ভোটটা দিতে পারি। কেউ যদি বাধা দেয় তাহলে এবার আর কাউরে ছাড় দিবো না। প্রতিবাদ করুম। তিনি আরও বলেন, এ উপজেলায় আওয়ামী লীগের অসংখ্য ভোট রয়েছে। সকল দল চাইছে এই ভোটগুলো তাদের দলে পড়ে।
অন্যদিকে, কয়েক কিলোমিটার দূরে, আগানগর কলেজের আড্ডায় একেবারেই ভিন্ন চিত্র। বড় বটগাছের ছায়ায় জড়ো হয়েছে তরুণরা। হাতে খাতা-কলম নয়, মোবাইল ফোনে চলছে রাজনৈতিক আলোচনার ভিডিও দেখা। এখানকার তরুণ ভোটারদের ভাবনা ভিন্ন। কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ‘প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন’ (পিআর) পদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় আগ্রহ দেখান। তাদের মতে, পিআর ব্যবস্থা শুরু হলে দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসতে পারে। তবে পিআর নিয়ে তারা খুব বেশিকিছু জানেন না বলে অনেকে উল্লেখ করেন।
সরকারি শহীদ স্মৃতি কলেজের শিক্ষার্থী তারেক হোসেন বলেন, আমরা চাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পাশাপাশি সংসদে পিআর পদ্ধতি চালু হোক। এতে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স তৈরি হবে।
আগানগর সরকারি ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী মঈন আহমেদ বলেন, আমরা জেন-জি প্রজন্ম নতুন কিছু চাই। পিআর চালু হলে পেশিশক্তি ও কালো টাকার প্রভাব কমবে। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে, তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেটা গ্রহণযোগ্য তাই হওয়া উচিত।
বরুড়া শহীদ স্মৃতি কলেজের ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার বলেন, আমরা চাই ভোটের রাজনীতিতে সবার অংশগ্রহণ থাকুক। ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বরুড়ার শিক্ষার্থী মাহিন কবীর বলেন তরুণরা পরিবর্তনের পক্ষে।
বরুড়া পৌর বিএনপি’র সভাপতি, শামসুল হক সরদার মানবজমিনকে বলেন, এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে আমাদের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বরুড়া উপজেলার যানজট নিরসনে আমরা অনেকগুলো বৈঠক করেছি। তিনি আরও বলেন, এখানে বিএনপি’র একক প্রার্থী জাকারিয়া তাহের সুমন ভাইয়ের দিকনির্দেশনায় আমরা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি। ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগর নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা না করা জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন সুমন ভাই। তিনি আমাদের কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন- কেউ যেন প্রতিশোধমূলক কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত না হই। যুব সমাজকে আকৃষ্ট করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা সুমন ভাইয়ের নির্দেশে প্রতিটি এলাকার যুবকদের তালিকা করছি। তারা কি চায় আমরা তাদের মতামত নিবো। এ ছাড়া গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা দলের পক্ষ থেকে বৃত্তির ব্যবস্থা করছি। তিনি আরও বলেন, এ এলাকা কৃষি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। আমরা চেষ্টা করছি সরকারিভাবে যেসকল সার-বীজ আসে তা কৃষকের হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য। বরুড়া পৌর জামায়াতের সেক্রেটারি আনোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচন ঘিরে আমরা গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি। জনগণ এখন নতুন মুখ দেখতে চায়। বিশেষ করে জেন-জিরা অনেক স্মার্ট তাদের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আমরা পিআরের
পক্ষে গণসংযোগ করে যাচ্ছি। নির্বাচনে কালো টাকার ছড়াছড়ি না হলে এ আসনে ইনশাআল্লাহ্ অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম হেলাল জিতবেন। আমরা ভাগ্যবান যে তার মতো মেধাবী মানুষকে পেয়েছি। উল্লেখ্য, প্রায় সাড়ে তিন লাখ ভোটারের এই আসনে সর্বশেষ তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুইজন এবং জাতীয় পার্টির একজন এমপি হন।