Image description
 

ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনে মুন্সীগঞ্জ জেলায় দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। এ সময় কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশ প্রশাসনের ছত্রছায়ায় মুন্সীগঞ্জ বিএনপির দুই নেতাকে নির্মমভাবে কুপিয়ে খুন করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। এছাড়া এক যুবদল কর্মীর চোখ উপড়ে ফেলার ঘটনা জেলার রাজনীতির ইতিহাসে দারুণ ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী হত্যাযজ্ঞে জেলার ১৬ জন শহীদ হন।

 

স্থানীয় বাসিন্দা ও সচেতন মহলের অভিযোগ, ২০০৯ সালের পর স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ, সেখান থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত সব স্তরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মুন্সীগঞ্জের সর্বত্র ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। কোরবানির হাটসহ বিভিন্ন উপজেলার হাটবাজার ও ঘাট আওয়ামী লীগ ছাড়া ইজারা কেউ পেত না। সে সময় বিরোধী রাজনৈতিক দল তথা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের সভা-সমাবেশের সাংবিধানিক অধিকার ছিনিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ ও তাদের পোষা প্রশাসন।

 
 
নিউইয়র্ক থেকে কেউ যেন ‘অক্ষত ফিরতে না পারে’

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর মুন্সীগঞ্জ জেলা শহরের কার্যালয়টি ১৫ বছর তালাবদ্ধ রাখা হয়। জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের পেলেই মারধর ও হত্যা করাকে জায়েজ করে ফেলে আওয়ামী লীগ। আর বিএনপির কার্যালয়ে ১০ বারের বেশি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ লুটপাট করা হয়। কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ককে পিটিয়ে জখম করা হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষিত হলেই পুলিশ আর আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা বিএনপির কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখত। আওয়ামী দুঃশাসনে জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মতো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ছাড়াও প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নেতৃত্ব অলিখিত নিয়মে পরিণত করা হয়েছিল।

বর্বরোচিত হত্যা ও নির্যাতন, শোকে মারা যান মা ও বোন

মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিম পৌরসভার মুরমার গ্রামে আওয়ামী দুঃশাসনের শিকার হন বিএনপির দুই নেতা। বিএনপিঘোষিত কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে শহীদ হন দুজন। তারা হলেন- মুরমা গ্রামের নুর মোহাম্মদের ছেলে ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আকবর হোসেন (৩৮) ও একই ওয়ার্ডের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম শাওন (২৬)।

আকবর ভাই মুক্তার হোসেন বলেন, ২০১০ সালের ১৯ মে ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে তৎকালীন জেলা বিএনপি সভাপতি আবদুল হাইয়ের নেতৃত্বে মুন্সীগঞ্জের নেতাকর্মীরা লঞ্চে করে ঢাকায় রওনা হন। লঞ্চটি সদরঘাট টার্মিনালে পৌঁছালে, লাল বাহিনী নামধারী আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বর্বরোচিত হামলা চালায়।

এ সময় মুরমা গ্রামের নুর মোহাম্মদের ছেলে ৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আকবর হোসেন (৩৮) আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে তলিয়ে যায়। একদিন পর লাশ ভেসে ওঠে। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা আকবরকে তাদের কর্মী দাবি করে। পুলিশও তাতে সায় দেয়। পরে লাশের পকেটে থাকা মোবাইল ফোন ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে তাকে শনাক্ত করলে আওয়ামী লীগের চালাকি বন্ধ হয়। এদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারানোর শোকে তিন মাসের মধ্যে মারা যান সত্তরোর্ধ্ব মা জাহেরা খাতুন ও বোন ময়না বেগম। নির্মমতার নজিরবিহীন এই হত্যাকাণ্ডে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।

অন্যদিকে ২০২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি এবং দলীয় নেতাকর্মীদের গুম-খুনের প্রতিবাদে দেশব্যাপী কর্মসূচির ডাক দেয় বিএনপি। এদিন মুন্সীগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে মুক্তারপুরে শান্তিপূর্ণ বিশাল সমাবেশে পুলিশ বিনা উসকানিতে রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এ সময় ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসী ও পুলিশের আক্রমণে মুরমা গ্রামের ছোয়াব আলী ভূঁইয়ার ছেলে শহিদুল ইসলাম শাওন (২৮) মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। মৃত্যুর পরে কড়া পুলিশ প্রহরায় শাওনের লাশ দাফন করা হয়।

নির্মমতার এখানেই শেষ নয়। পুত্রশোকে কাতর অসহায় ছোয়াব আলী ও তার পরিবারকে প্রশাসনের মনগড়া বিবৃতি দিতে চাপ দেয়। পরে প্রাণভয়ে পরিবারসহ ও দলের নেতাদের পরামর্শে মুখে গামছা প্যাঁচিয়ে সবার অগোচরে ঢাকায় গিয়ে আত্মাগোপন করেন ছোয়াব আলী।

গায়েবানা জানাজা থেকে বিএনপি নেতাকে গ্রেপ্তার, নিন্দার ঝড়

২০২৪ সালের আন্দোলনে উত্তাল দেশ। ১৬ জুলাই পুলিশের বুলেটের আঘাতে শহীদ হন আবু সাঈদ। বর্বরোচিত এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৭ জুলাই মুন্সীগঞ্জ শহরের সুপার মার্কেট চত্বরে বিএনপি কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে গায়েবানা জানাজার অবস্থায় শহর বিএনপি সদস্য সচিব মাহবুব উল আলম স্বপন এবং জানাজার ঈমাম ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির নেতা আবদুর রহমান হীরণকে টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যান সদর থানার ওসি নেতৃত্বে একদল পুলিশ। তাদের গ্রেপ্তারের এই ঘটনা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় মুহূর্তে ভাইরাল হয়। দেশ-বিদেশে নিন্দার ঝড় ওঠে।

১২ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা

সরকারি কৌঁসুলি মো. হালিম হোসেন এবং জিপি ও জেলা আইনজীবী ফোরামের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তোতা মিয়ার বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ জেলার ৮৫টি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ পাঁচ হাজার এজাহারনামীয় এবং অজ্ঞাতনামা আরো সাত হাজারসহ সর্বসাকুল্যে ১২ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। সবগুলো মামলাই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে বিরত রাখার অপকৌশল। যারা অধিকতর সক্রিয় থেকেছেন তাদের নামে মামলার সংখ্যাও বেড়েছে। বিভিন্ন অজুহাতে বিএনপি জামায়াতের স্থানীয় নেতা হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দিয়ে ঘরছাড়া করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেককেই জেলে যেতে হয়েছে। এদের মধ্যে ছিলেন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতা।

সরকারি কৌঁসুলির কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক ৫৫টি মামলা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮টি ইতোমধ্যে খারিজ হয়েছে। বাকি সাতটির নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াধীন।

জেলায় সবচেয়ে ক্ষমতাসীন মহিউদ্দিন পরিবার

আওয়ামী লীগ আমলে জেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাসীন ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সহচর ও ১৯৮০ সাল থেকে জেলা আওয়ামী লীগের বারবার নির্বাচিত সভাপতি মো. মহিউদ্দিন আহমেদের পরিবার। এ পরিবারের কর্তা মো. মহিউদ্দিন আহমেদ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান; তার আপন ছোট ভাই আনিসুজ্জামান আনিস পর্যায়ক্রমে চারবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ছেলে মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব দুবার মেয়র এবং পরে ২০২৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে এমপি হন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ফয়সাল বিপ্লব মুন্সীগঞ্জ পৌরসভা থেকে অব্যাহতি নেওয়া মেয়র পদে তার সহধর্মিণী চৌধুরী ফারিয়া আফরিন মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নারী মেয়র হন। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এ পরিবারের বিরুদ্ধে পদ ও নানা মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ ছিল বিস্তর। এছাড়া নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করে পরিবারটি।

ফয়সাল বিপ্লবকে ইতোমধ্যে জুলাই আন্দোলনে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া পরিবারের অভিযুক্ত সদস্যদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট জনতার রোষে আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. মহিউদ্দিন আহমেদ এবং ছেলে ফয়সাল বিপ্লবের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট চালানো হয়। বর্তমানে জেলার চিহ্নিত আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মী লাপাত্তা। অনেকে নানাভাবে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। শীর্ষস্থানীয় নেতারা অগাধ সম্পদ বিদেশে পাচার করে আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন।

জুলাই বিপ্লবে শহীদ হন মুন্সীগঞ্জের ১৬ জন

জুলাই বিপ্লবের পুরো সময় রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলার ছাত্র, শিক্ষক, দিনমজুর, ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ যার যার অবস্থান থেকে সক্রিয় ছিল। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জ শহরের ইসলামপুর গ্রামের মো. সজল, নূর মোহাম্মদ ডিপজল, রিয়াজুল ফরাজীÑএই তিনজন গত বছরের ৪ আগস্ট পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহীদ হন। আন্দোলন চলাকালীন অন্যান্য জায়গায় শহীদ হন মুন্সীগঞ্জের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান, মোস্তফা জামান সমুদ্র, মেহেদী হাসান প্রান্ত, সাইদুল ইসলাম, শাহরিক চৌধুরী মানিক, শহিদ আল আমিন খলিফা, আশরাফুল অন্তর, ব্যবসায়ী মো. সোহেল রানা, রংমিস্ত্রি বাবুল হাওলাদার, প্রবাসী মুজিবুর রহমান সরকার শোভন, চাকরিজীবী মো. রাকিব হোসেন, শ্রমিক মো. আক্কাস আলী, ব্যবসায়ী ফরিদ শেখ।

রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য

আওয়ামী লীগের সময়ে মুন্সীগঞ্জে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলাম স্বাভাবিকভাবে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করার সুযোগ পেত না। কিছু কিছু কর্মসূচি স্থানীয় প্রশাসন অনুমতি দিলেও নানা বিধিনিষেধ আর সীমাবদ্ধতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেওয়া সম্ভব হতো না বলে জানিয়েছেন জেলা বিএনপি সদস্য সচিব মো. মহিউদ্দিন। শহর বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক মেয়র কেএম ইরাদত মানু বলেন, ‘জেলা শহরের কার্যালয় যে কোনো কর্মসূচি আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠন নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও থাকত নির্বিকার।

সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মাহবুব আলম স্বপন বলেন, ‘আমাদের অফিস স্টাফ দেলোয়ার, বর্ষীয়ান নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোতালেব, বিশিষ্ট ছাত্রনেতা বকুলসহ বেশকিছু নেতাকর্মীকে নির্মমভাবে পিটিয়ে জখম করা হয়েছে বারবার। দলীয় কার্যালয়ে তালা মেরে দিনের পর দিন আটকে রেখেছে।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর কার্যালয়টি আওয়ামী লীগের পুরো শাসনামলই তালাবদ্ধ ছিল বলে জানান জেলা আমির আ জ ম রুহুল কুদ্দুস। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর দলীয় কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ তারা বুঝে পেয়েছেন। আ জ ম রুহুল কুদ্দুস আরো বলেন, ফ্যাসিবাদের আমলে জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৫৬টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় ১৬০ জন আসামি ছিল। তিনি আগামীর বাংলাদেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারা প্রত্যাশা করেন যেন প্রতিটি দল স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ও কর্মসূচি পালন করতে পারে। আর কোনো ফ্যাসিবাদ যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। এ ব্যাপারে সবকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান এই জামায়াত নেতা।

সম্পাদনা: ইসমাঈল