Image description

চলতি বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশের আমদানি তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে দেশে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য ৬.২ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৯.৫ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত ডলার সংকট কাটিয়ে ওঠা, আমদানি নীতির শিথিলকরণ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার পর স্বাভাবিক ব্যবসার পুনরাবির্ভাব এই বৃদ্ধির মূল কারণ।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বন্দর কার্যক্রমে ব্যাঘাতের কারণে আমদানির পরিমাণ কমে গিয়েছিল। এবার সেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় আগের বছরের তুলনায় আমদানির উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জুলাইয়ে রেকর্ড আমদানি হলেও এটি প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে, কিন্তু ভোক্তা বাজারে চাহিদা সীমিত। ঋণপত্র, সুদহার এবং জীবনযাত্রার ব্যয় এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকায় সরবরাহ বেড়েও দাম স্থিতিশীল হচ্ছে না। পিপিআরসি’র সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ মানুষ দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকায় উদ্বিগ্ন। প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ এখনও আর্থিক সংকটে রয়েছেন, যেখানে ৬৭ শতাংশ চিকিৎসা ব্যয় এবং ২৭ শতাংশ ঋণ পরিশোধ নিয়ে সমস্যায় ভুগছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পণ্য সরবরাহ বাড়লেও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে না আসায় মূল্যস্ফীতি এখনও দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের দুশ্চিন্তা

নিত্যপণ্য যেমন- চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, সবজি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস কোনও কিছুই আগের দামে নেই। প্রতিদিন পণ্যের দাম বাড়ছে, যা সাধারণ মানুষের নিঃশ্বাস আটকে দিচ্ছে। একসময় মাসের শুরুতে একসঙ্গে বাজার করা পরিবারগুলো এখন বাজার ভাগ করে সপ্তাহে নামাচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় কম কিনে কোনও মতে বেঁচে থাকার লড়াই চালাচ্ছেন তারা।

মধ্যবিত্তের ভোজন তালিকাও ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। দাওয়াত বা মেহমানদারি এখন বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসা, শিক্ষা, যাতায়াত— সব খাতেই নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমূল্যের প্রভাব পড়ছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “একশ্রেণির ব্যবসায়ী বছরের পর বছর মূল্য কারসাজি করে ক্রেতাকে ঠকাচ্ছেন। সরকারের স্থায়ী পদক্ষেপ বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নেই। তদারকি কার্যকর নয়।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, ব্যবসায়ীর মনোগ্রাহী কৌশল এবং বাজার তদারকির অভাব একত্রে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে সরবরাহ থাকলেও দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

শিল্প খাতের চাহিদা ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি

সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহিয়া জুনেদ বলেন, “শিল্প খাতে চাহিদা ফের বেড়ে যাওয়াই এ বছরের আমদানি বৃদ্ধির মূল কারণ। এটি সাধারণ মানুষের ক্রয়শক্তি বৃদ্ধির কারণে নয়, বরং উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের জন্য।”

ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, “মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়েছে। তবে এটি প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং ব্যবসা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার প্রতিফলন।”

সাবেক ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, “ভোক্তা পণ্যের চাহিদা এখনও সীমিত। অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে, তবে পূর্ণ পুনরুদ্ধার হয়নি।”

পণ্যের ধরন অনুযায়ী আমদানি বৃদ্ধি

জুলাইয়ে বিভিন্ন পণ্যের আমদানি  বেড়েছে— মধ্যবর্তী পণ্য (যার মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামালও আছে) ৩.৮৪ বিলিয়ন ডলার, ২১ শতাংশ বৃদ্ধি। মূলধনী যন্ত্রপাতি ৪৫৬ মিলিয়ন ডলার, ৭১ শতাংশ বৃদ্ধি। পোশাক-সংক্রান্ত কাঁচামাল ১.৫২ বিলিয়ন ডলার, ১০.৩ শতাংশ বৃদ্ধি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা কিছু কারখানায় গ্যাস সংযোগ পাওয়ার পর উৎপাদন শুরু হওয়ায় আমদানির পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে।

গভর্নরের সঙ্গে শীর্ষ ২০ ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকের বৈঠক

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর শীর্ষ ২০ ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ব্যবসায়ীরা তাতে নিত্যপণ্যের আমদানি সহজ করার দাবি তোলেন। এছাড়া আলোচনায় ভোগ্যপণ্য আমদানিতে বিদ্যমান সীমা প্রত্যাহারের দাবি, ঋণপত্রের বদলে চুক্তিভিত্তিক আমদানি এবং ঋণের মেয়াদ ৯০ দিন থেকে ১৮০ দিন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়।

মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, “আমদানির বাধা কমালে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। বাজার বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।” নাবিল গ্রুপের এমডি আমিনুল ইসলাম স্বপন বলেন, “বাজার স্থিতিশীল রাখতে গভর্নর যেকোনও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।”

নতুন আমদানি-নীতি

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তিন বছরের (২০২৫-২৮) জন্য নতুন আমদানি নীতি প্রণয়ন করছে।

নতুন এই নীতিমালায় ন্যূনতম দর বা নগদ মার্জিনের বাধ্যবাধকতা থাকবে না। যেকোনও আমদানিকারক যেকোনও পরিমাণ পণ্য আমদানি করতে পারবেন। এলডিসি থেকে বের হওয়ার সময়কাল এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতি মাথায় রাখা হবে। বিদ্যমান নীতি আদেশের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৪ সালের জুনে। নতুন আদেশ জারি না হওয়া পর্যন্ত পূর্বের আদেশই কার্যকর থাকবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদিও আমদানির পরিমাণ বেড়েছে, ভোক্তা বাজারে চাহিদা সীমিত ও ঋণপত্রের উচ্চ সুদহার থাকায় পণ্যের দাম স্থিতিশীল হচ্ছে না। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এবং জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে না আসায় মূল্যস্ফীতি এখনও চ্যালেঞ্জ।a