
কোকেন পাচারের আন্তর্জাতিক ট্রানজিট রুটে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা কোকেনের চালান ঢুকছে ইউরোপ-আমেরিকায়। বাংলাদেশকে তৃতীয় দেশ হিসেবে ব্যবহার করে পাচারের সময় গত ১০ বছরে ৫০০ কেজি কোকেন জব্দ করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এর নেপথ্য হোতা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ছদ্মবেশী নাগরিক। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় ৪ কেজি কোকেন জব্দ করে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় চার বিদেশিকে আসামি করে সম্প্রতি আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। ওই মামলার তদারকি কর্মকর্তা মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হুমায়ন কবির বলেন, ‘বাংলাদেশকে কোকেন পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে মাদক মাফিয়ারা। বাংলাদেশ হয়েই ইউরোপ-আমেরিকায় ঢুকছে কোকেনের চালান। পাচারের নেপথ্যে রয়েছে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। একেকটি চালানের জন্য কোকেন ক্যারিয়ার বিমান, হোটেল ভাড়াসহ হাজার হাজার ডলার পেয়ে থাকেন।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কমপক্ষে ৫০০ কেজি কোকেন জব্দ করে। এর মধ্যে ২০২৪ সালে ১৩০ দশমিক ১৮, ২০২৩ সালে ১৩ দশমিক ০০৩, ২০২২ সালে ৪ দশমিক ৫৭, ২০২১ সালে ১ দশমিক ৫৫, ২০২০ সালে ৩ দশমিক ৮৯৩, ২০১৯ সালে ১ এবং ২০১৮ সালে ২৭২ কেজি কোকেন জব্দ করা হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধরা পড়ে ছোটবড় কোকেনের চালান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আন্তর্জাতিক মাদক সিন্ডিকেটের সদস্যরা কোকেনের চালান শুরুতে নাইজেরিয়া, তানজানিয়া, কলম্বিয়া, পেরু এবং বলিভিয়া থেকে নিয়ে আসে ব্রাজিলে। নৌ ও আকাশপথে ব্রাজিলে প্রবেশ করানো হয় কোকেনের চালান। আগে উত্তর আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ ব্যবহার করে ইউরোপ-আমেরিকায় কোকেন পাচার করা হতো। এসব পুরোনো পথে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যাপক তল্লাশির কারণে রুট পরিবর্তন করা হয়। সিন্ডিকেটগুলো দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য হয়ে বাংলাদেশ ও ভারতকে ব্যবহার করে ইউরোপ-আমেরিকায় পাচার করছে কোকেন। ব্রাজিল কিংবা পশ্চিমা দ্বীপপুঞ্জ থেকে কোকেনের চালান আসে মধ্যপ্রাচ্যে। এরপর ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হয়ে কোকেনের চালান ঢোকে বাংলাদেশে। দেশ থেকে কোকেনের চালান ইউরোপ-আমেরিকায় পাঠাতে তিনটি রুট ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ-ভারত-ইউরোপ রুট। আরেকটি হচ্ছে বাংলাদেশ-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ/আমেরিকা। অন্য রুটটি হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ইউরোপ কিংবা আমেরিকা। সিন্ডিকেটগুলোর নেপথ্যে রয়েছে নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, তানজানিয়াসহ আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশের নাগরিক। তারা ফুটবলার, গার্মেন্ট ব্যবসায়ী কিংবা নানান পেশার ছদ্মবেশে কোকেন বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জব্দ করা সব চালানই বাংলাদেশ হয়ে অন্য দেশে যাচ্ছিল। বাহকের তালিকায় বেশির ভাগই ছিল আফ্রিকার নাগরিক।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) ২০২৩ সালের প্রকাশিত বিশ্বের কোকেন ব্যবহারকারী অঞ্চলসমূহের পরিসংখ্যানে বলা হয়, উত্তর আমেরিকার ৫ দশমিক ৫, ইউরোপের ৫ দশমিক ৭, ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপসমূহের ৫ দশমিক ২ এবং এশিয়ার দেশসমূহের ২ দশমিক ৯ মিলিয়ন লোক কোকেন আসক্ত।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে কোকেন উচ্চ মূল্যের হওয়ায় বাংলাদেশে এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। তাই দেশের মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোয় কোকেন আসক্ত কোনো রোগী আসে না।