
নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক প্রতিকূল অবস্থা, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও আদায় কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতের আর্থিক কাঠামো ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে।
নীতিসহায়তার অধীনে ঋণের দুই শতাংশ পরিশোধ করে ১০ বছরের জন্য নিয়মিত করার সুযোগ পাওয়া যাবে। অতীতে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত ও অব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান এবং সচল রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান এই সুবিধা পাবে। পাশাপাশি অতীতে নীতিসহায়তার আওতায় ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ, পুনর্গঠন ইত্যাদি পাননি—এমন ব্যবসায়ীরা অগ্রাধিকার পাবেন।
এ সময়ে যে কোনো পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন করা যাবে। তবে ৩০০ কোটি টাকা বা তার বেশি খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে নীতিসহায়তা দেওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে আন্তঃব্যাংক সভার কার্যবিবরণী বা পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনসহ “ব্যবসা ও আর্থিক ব্যবস্থাদি পুনর্গঠনের লক্ষ্যে গঠিত নীতিসহায়তা সংক্রান্ত বাছাই কমিটি”র কাছে পাঠাতে হবে।
সরকারের এই নীতিসহায়তার ফলে রুগ্ন ও সংকটে থাকা শিল্প কারখানা ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি হবে। তবে নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে অতীতে এ ধরনের নীতির অপব্যবহারের কারণে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা লুট হয়েছে। এজন্য নতুন এই নীতি প্রয়োগে আবেদন সঠিকভাবে যাচাই, প্রভাবশালীকে বিশেষ সুবিধা না দেওয়া এবং অপব্যবহার রোধে মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ।
যে উদ্দেশ্যে এই নীতিসহায়তা দেওয়া হয়েছে, সেটি ভালো উদ্যোগ। একই সাথে এই সার্কুলারের উদ্দেশ্যও ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন নিট তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, “এটা স্বীকার করতেই হবে, গত আন্দোলনে এবং তার আগেও ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ খুঁড়িয়ে চলেছেন। এই সার্কুলার জারি এবং এর সফল প্রয়োগের ফলে তারা সুবিধা পাবেন; আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। ”
তবে এই নীতি সুবিধার সফল প্রয়োগের তাগিদ দেন এই উদ্যোক্তা নেতা। তিনি বলেন, “খেলাপি দুই ধরনের—এক. ইচ্ছাকৃত খেলাপি, দুই. পরিস্থিতির শিকার হয়ে খেলাপি। ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা আগেও সুবিধা নিয়ে আবার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পাচার করেছেন। আবারও এই নীতি সুবিধা নেওয়ার জন্য বসে আছেন। তারা যেন নানা কৌশল অবলম্বন করে সুবিধা নিতে না পারেন। তারা সুবিধা পেলেই আবার টাকা নেবেন, আবার পাচার করবেন। এমন লোক যেন কোনোভাবেই সুবিধা না পায়। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু সৎ ব্যবসায়ীরা যেন সুবিধা পান। ”
নীতিসহায়তায় ৩০০ কোটি টাকার নিচে ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে দুই শতাংশ হারে ডাউন পেমেন্ট নিয়ে ব্যাংক তা ১০ বছরের জন্য নবায়ন বা পুনর্গঠন করবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের পরিচালকরা যেন নিজেদের মধ্যে সুবিধা না নেন বা কোনো প্রভাবের কাছে মাথা নত না করেন। গ্রাহকের ব্যবসার বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাবনা দেখে পুনর্গঠন করতে হবে। কোনো ঋণগ্রহীতা সম্পর্কে ব্যাংকই ভালো জানে এবং সেই ভিত্তিতেই পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে কেউ আবারও ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিয়ে যেতে না পারেন; এমন মন্তব্য করেন এই উদ্যোক্তা নেতা।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের নীতি সুবিধা দিতে এবার সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়েছে, ৩০০ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণগ্রহীতার ক্ষেত্রে ব্যাংক সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে আন্তঃব্যাংক বা পর্ষদের সিদ্ধান্তসহ “ব্যবসা ও আর্থিক ব্যবস্থাদি পুনর্গঠনের লক্ষ্যে গঠিত নীতিসহায়তা সংক্রান্ত বাছাই কমিটি”র কাছে পাঠাতে হবে। এই কমিটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। যারা আগে এ ধরনের সুবিধা পাননি, তারা অগ্রাধিকার পাবেন। এ ছাড়া দৃষ্টিভঙ্গিজনিত বৈষম্যের শিকার এবং প্রতিশ্রুত ইউটিলিটি সংযোগ বা সরবরাহ না পাওয়া ব্যবসায়ীরাও এই সুবিধা পাবেন।
এসবকে এই সার্কুলারের ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তার সৎ উদ্দেশ্য থেকেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন বিকেএমইএ-এর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক এবং বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি মো. শাহরিয়ার।
মো. শাহরিয়ার বাংলানিউজকে বলেন, “এখানে বৈষম্যের কথাও বলা হয়েছে। কোনো প্রকৃত ব্যবসায়ী যদি বৈষম্যের শিকার হন তাহলে তিনি এই সুবিধা পাবেন। কিন্তু যারা টাকা নিয়ে চলে গেছেন, ঋণখেলাপি, করখেলাপি—তারা যেন কোনোভাবেই এই সহায়তা না পান। যদি তারা পান, তাহলে আবার ব্যাংক থেকে টাকা নেবেন, আবার পালিয়ে যাবেন। এটা অর্থনীতির জন্য নতুন করে অশনিসংকেত বয়ে আনবে। যদি কোনো ইচ্ছাকৃত খেলাপি এই সুবিধা পান এবং আবার টাকা নিয়ে পালান, তাহলে সেই টাকা তুলতে নিয়মিত লেনদেনকারী সৎ ব্যবসায়ীদের ওপর বাড়তি সুদ চাপানো হবে। আমাদের ওপর আবারও বাড়তি চাপ তৈরি হবে। ”
প্রতিশ্রুত ইউটিলিটি সংযোগ বা সরবরাহ না পাওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের বাছাই করে এই সহায়তা দেওয়া হলে সেটি ভালো উদ্যোগ হবে বলে মনে করেন এই উদ্যোক্তা নেতা।
দেশে তৈরি পোশাক শিল্প দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানি বাণিজ্যের চালকের আসনে রয়েছে। রপ্তানি বাণিজ্যের ৮৫ ভাগ আসে এই খাত থেকে। কোনো সংকট তৈরি হলে এই খাতের উদ্যোক্তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। গত বছরের সরকারবিরোধী আন্দোলনে অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। অনেক কারখানা এখনো টিকে থাকলেও কার্যত টিকে নেই। সরকারের এই ঋণ পুনর্গঠন নীতিসহায়তার ফলে তৈরি পোশাক খাতের অনেক কারখানা সুবিধা পাবে বলে মনে করছেন তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল।
যে পথে হেঁটে ব্যাংকিং খাতের সর্বনাশ হয়েছে, কোনো ফলাফল আসেনি, সেই পথেই আবার হাঁটা শুরু হলো—এমন মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, “এ ধরনের সুবিধা ২০১৬ সালের পর কয়েকবার দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালে একটি মাস্টার সার্কুলার জারি করে এ ধরনের উদার সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে সময়ের অভিজ্ঞতা হলো—খেলাপি ঋণ কমেনি, বরং পুনঃতফসিল ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। নতুন নীতিসহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক আবারও সেই পথে অগ্রসর হলো। এবারও তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে, প্রতিবছর বাড়বে খেলাপি ঋণ।