
অতীতে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন চার মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তারা হলেন— থিওডোর রুজভেল্ট, জিমি কার্টার, উড্রো উইলসন ও বারাক ওবামা। এবার ডোনাল্ড ট্রাম্পও নোবেলপ্রাপ্ত মার্কিন প্রেসিডেন্টের তালিকায় নিজের নাম লেখাতে চান। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার তিনি বিভিন্ন জনসমাগমে নিজেকে নোবেল পুরস্কারের জন্য ‘যোগ্য দাবিদার’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সবশেষ মঙ্গলবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৮০তম অধিবেশনেও বিষয়টি উত্থাপন করেছেন তিনি। ট্রাম্পের ভাষায়, ‘সবাই মনে করেন, আমার নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত।’
রুশো-জাপানিজ যুদ্ধ থামিয়ে ১৯০৬ সালে থিওডোর রুজভেল্ট, লিগ অব ন্যাশনস গঠনের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯১৯ সালে উড্রো উইলসন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও গণতন্ত্রে অবদানের জন্য ২০০২ সালে জিমি কার্টার এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও সহযোগিতা সম্প্রসারণে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৯ সালে বারাক ওবামা নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন।
যে সাত যুদ্ধ ‘থামিয়েছেন’ ট্রাম্প
মঙ্গলবার ইউএনজিএ’র ৮০তম অধিবেশনে ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি এ পর্যন্ত সাতটি যুদ্ধ থামিয়েছেন। এর আগে মধ্যপ্রাচ্যে তার বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফও একই কথা বলেছেন। ট্রাম্প যেসব যুদ্ধ থামানোর দাবি করে থাকেন সেগুলো হলো— আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের দীর্ঘ চার দশকের দ্বন্দ্ব নিরসন, চলতি বছর থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সংঘাত নিরসনে চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান, আফ্রিকার দুই দেশ রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর মধ্যে চলতি বছরের শুরুর দিকে শান্তি স্থাপনে ভূমিকা, ইরান-ইসরাইলের মধ্যে ‘১২ দিনের যুদ্ধ’ থামানো, সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তানকে চুক্তিতে আবদ্ধ করা, মিশর ও ইথিওপিয়ার মধ্যে এক যুগ ধরে চলা অচলাবস্থার অবসান ঘটানো এবং সার্বিয়া-কসোভোর দ্বিপাক্ষিক লড়াইয়ের ইতি টানায় অবদান।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনে চলমান নিষ্ঠুর যুদ্ধ থামাতে খুব সামান্যই করেছেন, অথচ তিনি গাজায় নেতানিয়াহুর সর্বাত্মক যুদ্ধকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছেন।
মার্ক শ্যানাহান, অধ্যাপক, সারে বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য
শান্তিচুক্তি নিয়ে সমালোচনা
ফরেন পলিসি’র এক নিবন্ধে ড্যামিয়ান মারফি লিখেছেন, দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসে মাত্র ৮ মাসে ট্রাম্প যত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পরিচালনা করেছেন জো বাইডেন চার বছরের ক্ষমতাকালেও এতো বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেননি। তিনি ট্রাম্পের সাতটি যুদ্ধ থামানোর দাবিগুলো খণ্ডন করেছেন। এতে তিনি প্রমাণ করেন, যুদ্ধ থামানোর দাবিগুলো সারবত্তাহীন ও অযৌক্তিক। অর্থাৎ পুরোপুরি শান্তি স্থাপনে ট্রাম্প আসলে অপারগ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তিচুক্তির দাবি করলেও বাস্তবে এগুলো কার্যকর হয়নি—বরং অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। নাগোর্নো-কারাবাখে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান চুক্তি বাস্তুচ্যুতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে; বরং মার্কিন কোম্পানির অর্থনৈতিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কঙ্গোতে এম২৩ বিদ্রোহীদের সহিংসতা বাড়ছে, জুলাইয়ে অন্তত ১৪০ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। ট্রাম্পের চুক্তিতে কোনো প্রয়োগ বা দায়বদ্ধতার ব্যবস্থা নেই।

ভারত-পাকিস্তানে ট্রাম্প শান্তির কৃতিত্ব দাবি করলেও ভারত তা অস্বীকার করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি করেছে। বলকানে কসোভো-সার্বিয়া বিরোধ এখনো মীমাংসিত হয়নি, ট্রাম্পের ওয়াশিংটন চুক্তি কার্যত অচল। থাইল্যান্ড–কম্বোডিয়া সীমান্তে যুদ্ধবিরতির পরও সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে ট্রাম্পের উদ্যোগকে ‘লোক দেখানো’ বলা হচ্ছে।
এদিকে তিনি সাতটি যুদ্ধ থামানোর কথা বললেও বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গাজা ও ইউক্রেনে রক্তপাত এখনো থামেনি। গাজা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ইসরাইলকে শর্তহীন অস্ত্র দেওয়ায় সংঘাত আরও বেড়েছে; ইউক্রেনেও যুদ্ধ অব্যাহত।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। অর্থাৎ একজন আসামি আরেকজন ব্যাক্তিকে, যিনি ‘গাজাকে জাহান্নামে’ পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছেন, নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিয়েছেন।
নোবেল মনোনয়ন, জরিপ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
নোবেল পাওয়ার জন্য ট্রাম্পের প্রচারণা নতুন নয়। ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামে জনসাধারণ, দলীয় ব্যাক্তিবর্গ বা নানা দেশের নেতাদের সামনে নিজেকে নোবেলের দাবিদার বলে উল্লেখ করেছেন। ইতিমধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ১২ বার নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। সর্বপ্রথম দেওয়া হয় ২০১৮ সালে। সেসময় দুই নরওয়েজিয়ান আইনপ্রণেতা তাকে মনোনয়ন দেন। এরপর ২০২০ সালে, ২০২৪ এবং সর্বশেষ চলতি বছর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত এবং পাকিস্তান তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেন।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। অর্থাৎ একজন আসামি আরেকজন ব্যাক্তিকে, যিনি ‘গাজাকে জাহান্নামে’ পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছেন, নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিয়েছেন। এটা নিয়েও নানাবিধ প্রশ্ন রয়েছে।
মার্কিনিদের অভিমত
নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনই (৭৬%) মনে করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্য নন। ওয়াশিংটন পোস্ট ও ইপসস পরিচালিত এই জরিপে ১১ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ২ হাজার ৫১৩ জন অংশ নেন। ফলাফলে দেখা যায়, ৭৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেন ট্রাম্প নোবেল পুরস্কারের যোগ্য নন, ২২ শতাংশ বলেছেন তিনি যোগ্য।
রিপাবলিকান ভোটারদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ ট্রাম্পকে যোগ্য মনে করলেও সমান সংখ্যক ভোটার তাকে অযোগ্য বলেছেন। অর্থাৎ দলের ভেতরেই এ বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত মতামত রয়েছে। জরিপে আরও দেখা যায়, ৬০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মোকাবেলায় ট্রাম্পের ভূমিকা নিয়ে অসন্তুষ্ট। ৫৮ শতাংশ ইসরাইল-গাজা পরিস্থিতি সামলানোর তার পদক্ষেপকে সমর্থন করেননি।
রক্তাক্ত গাজা বনাম ট্রাম্পের নোবেল
গাজায় ইসরাইলের বর্বরতায় এ পর্যন্ত ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, ট্রাম্প যদি সত্যিই নোবেল শান্তি পুরস্কার জিততে চান, তবে গাজা যুদ্ধ থামাতে হবে। মঙ্গলবার জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে থাকাকালে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ম্যাক্রোঁ বলেছেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার তখনই সম্ভব, যদি এই যুদ্ধ বন্ধ হয়। তাই ইসরাইলি সরকারকে গাজায় সংঘাত থামাতে চাপ দেওয়া জরুরি। তিনি আরও বলেন, এর জন্য শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছাই যথেষ্ট। যদি গাজা শহরে যুদ্ধ চলতেই থাকে, যদি সেনারা আজও সামনে এগিয়ে গিয়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা করতে থাকে, তবে আমরা নিশ্চুপ থাকতে পারি না।

ম্যাক্রোঁ বলেন, ইসরাইলের বর্তমান নীতি কোনো পরিকল্পনা নয় বরং নিজেদের জনগণকে অবিরাম যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্ক শ্যানাহান নিউজউইককে বলেন, ট্রাম্পের মন্ত্রিসভা হলো চাটুকারিতার এক মহড়া, যেখানে প্রতিটি সদস্যই চেষ্টা করে অন্যদের ছাড়িয়ে গিয়ে প্রেসিডেন্টের পায়ের কাছে প্রশংসায় ভাসাতে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনে চলমান নিষ্ঠুর যুদ্ধ থামাতে খুব সামান্যই করেছেন, অথচ তিনি গাজায় নেতানিয়াহুর সর্বাত্মক যুদ্ধকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছেন।
এই বিশেষজ্ঞা আরও বলেন, নোবেল বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে মেলবন্ধন ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করায় অবদানের জন্য নোবেল দেওয়া হয়। অথচ তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি চিঠিতে ম্যালকম রাশ নামের একজন লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি কূটনীতিবিমুখ এবং অশান্তিপ্রিয় প্রেসিডেন্টের মতো একজনকে নেলসন ম্যান্ডেলা, দালাই লামা এবং মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের মতো পুরস্কারপ্রাপ্তদের সঙ্গে যুক্ত করা হাস্যকর।
ওই চিঠিতে ট্রাম্পের একটি ছবি ব্যবহার করেছে দ্য গার্ডিয়ান। ছবিটির ক্যাপশন— ‘তিনি মনোনীত হয়েছেন, এটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ না (হিটলারও মনোনীত হয়েছিলেন)।’