Image description
♦ বিচারাধীন সাড়ে ৪৬ লাখের বেশি ♦ ৮ হাজার বেড়েছে আপিল বিভাগে, ভোগান্তির পাশাপাশি ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে- আইনজ্ঞদের অভিমত

দেশে এখন ভয়াবহ মামলাজট। বিচারাধীন মামলা বাড়ার গতি কমানোই যাচ্ছে না। সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান বলছে, শুধু গত ৯ মাসে সারা দেশে মামলা বেড়েছে ২ লাখের বেশি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছর ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে বিচারাধীন মামলা ছিল ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫১০টি। চলতি বছরের জুন মাস শেষে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৬ লাখ ৫২ হাজার ২৬০টিতে।

আইনজ্ঞরা বলছেন, বিচারাধীন মামলা লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। মামলাজটের কারণে একদিকে যেমন বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ বাড়ছে, অন্যদিকে বিচারে বিলম্বের কারণে ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়েও শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। তাই এখনই মহাপরিকল্পনা করে পাহাড়সম এই মামলার জট নিরসন করতে হবে বলে তাদের মত।

বিচার বিভাগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মামলা নিষ্পত্তির তুলনায় দায়েরের সংখ্যা বেশি হওয়ায় জট বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা কম থাকায় নিষ্পত্তিও বাড়ছে না। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে মামলাজট নিরসনে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির ঘোষিত রোডম্যাপেও মামলাজট নিরসনে কিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও     প্রধান বিচারপতির ঘোষিত রোডম্যাপ পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে মামলাজট কমতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সুপ্রিম কোর্টের বিবরণী শাখার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে বিচারাধীন মামলা ছিল ৪৬ লাখ ৫২ হাজার ২৬০টি। এর মধ্যে আপিল বিভাগে ৩৭ হাজার ২টি ও হাই কোর্ট বিভাগে ৬ লাখ ১৬ হাজার ৪৫৩টি মামলা বিচারাধীন ছিল। অন্যদিকে একই সময়ে অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩৯ লাখ ৯৮ হাজার ৮০৫টি।

একই শাখার গত বছর ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশের সব আদালতে বিচারাধীন মামলা ছিল ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫১০টি। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ২৮ হাজার ৯০১টি এবং হাই কোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৮০টি বিচারাধীন ছিল। অন্যদিকে অধস্তন আদালতে বিচারাধীন ছিল ৩৮ লাখ ৩৭ হাজার ৩২৯টি মামলা।

এই দুইটি পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৯ মাসে বৃদ্ধি পাওয়া ২ লাখ ৮ হাজার ৭৫০টি মামলার মধ্যে উচ্চ আদালতে ৪৭ হাজার ২৭৪টি। অন্যদিকে অধস্তন আদালতে বৃদ্ধি পেয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৪৭৬টি মামলা। উচ্চ আদালতে বৃদ্ধি পাওয়া মামলাগুলোর মধ্যে হাই কোর্ট বিভাগে ৩৯ হাজার ১৭৩টি এবং আপিল বিভাগে ৮ হাজার ১০১টি মামলা।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও স্পেশাল অফিসার মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিচার বিভাগ সংস্কারে প্রধান বিচারপতি ইতোমধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। এই রোডম্যাপের অনেক কিছুর বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে। এই রোডম্যাপ পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে মামলাজট নিরসনেও ভূমিকা রাখবে।

এ বিষয়ে জনস্বার্থ মামলার আইনজীবী হিসেবে খ্যাত সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মামলাজটের কারণে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি বাড়ছে। আবার বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক সময়ই সাক্ষী না আসাসহ নানা ধরনের সংকট তৈরি হয়। তৈরি হয় ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিয়েও শঙ্কা। তাই শুধু পরিকল্পনা নয়, মহাপরিকল্পনা করে মামলাজট বৃদ্ধির প্রধান দুই কারণ নিয়ে কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের মামলাজট বাড়ার প্রধান দুই কারণ- একটি হচ্ছে, আমরা মামলা দায়েরও ঠেকাতে পারছি না, অন্যটি দ্রুত নিষ্পত্তিও করতে পারছি না। সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, মূল কাজটা না করে মুখে যদি বলতে থাকি মামলাজট কমাতে হবে, তাহলে এটা কোনো সমাধান নয়। মামলাজটের লাগাম টানতে হলে বিচারকের সংখ্যা অন্তত তিন গুণ বৃদ্ধি করতে হবে, লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে মামলার উৎপাদন কমানোর বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।

জানতে চাইলে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের অন্যতম সদস্য, সাবেক জেলা জজ মাসদার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মামলাজটের অন্যতম কারণ মামলা দায়ের অনেক বেশি হচ্ছে। ছোট ছোট বিষয়েও মামলা হয়। তিনি বলেন, আবার বিচারকসংখ্যা কম থাকায় মামলা নিষ্পত্তিও বাড়ছে না। ফলে জট বাড়ছে।

সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, ‘মামলাজট নিরসনে আমরা বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছি কমিশনের প্রতিবেদনে। এর মধ্যে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য আমরা অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছি। এটা করতে পারলে খুব দ্রুত অনেক বিচারাধীন মামলা কমানো যাবে। একই সঙ্গে আরও অধিকসংখ্যক বিচারক নিয়োগের সুপারিশও করা হয়েছে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।’

জানা গেছে, গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের দেওয়া ৩৫২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে মামলাজট কমানোসহ ৩২ বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বে গঠন করা বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে মামলাজট নিরসনের বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়াসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। অধস্তন আদালতের বিচারকসংখ্যা অন্তত ৬ হাজারে উন্নীত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে সুপারিশে। অন্য সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও বিচারক নিয়োগে কমিশন গঠন; অধস্তন আদালতে বিচারক নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা। স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ, বিচার বিভাগকে যথাসম্ভব নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা। বিচার বিভাগের যথাযথ বিকেন্দ্রীকরণ এবং মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। এসব সুপারিশের মধ্যে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশসহ বেশ কিছু সুপারিশ এরই মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে। আইন সংশোধনসংক্রান্ত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নেও কাজ চলছে বলে জানা গেছে।